এটি পশ্চিমবঙ্গের নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় (recruitment scam) নতুন মোড়। ২০১৭ সালের কথোপকথনের একটি অডিয়ো রেকর্ডিং, যেখানে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম ৭৩ বার উল্লেখ করা হয়েছে, তা সিবিআই আদালতে পেশ করেছে। সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র (কালীঘাটের কাকু), কুন্তল ঘোষ, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়সহ একাধিক ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শোনা যায় ওই রেকর্ডিংয়ে।
সিবিআইয়ের চার্জশিট অনুসারে, টেট দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের মাধ্যমে টাকার লেনদেন সংক্রান্ত বিষয়ে এই কথোপকথন হয়। সুজয়কৃষ্ণের বক্তব্য অনুযায়ী, অভিষেক ১৫ কোটি টাকা দাবি করেছিলেন। সেই টাকা তোলার পরিকল্পনাও আলোচনায় আসে। তবে সিবিআই এখনও অভিষেককে তলব করেনি এবং অডিয়োর সত্যতা যাচাই করছে।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগকে রাজনৈতিক চক্রান্ত বলে দাবি করেছে। সিবিআইয়ের তদন্তের ভিত্তিতেই পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ ঠিক হবে।
উল্লেখ্য, প্রায় সওয়া এক ঘণ্টার কথোপকথন। ঠিকঠাক হিসাব করলে ৭২.৫৯ মিনিট। তাতে ধরা পড়েছে মোট সাত জনের কণ্ঠস্বর (তার মধ্যে একটি তোতাপাখি)। সেই কথোপকথনে মোট ৭৩ বার শোনা গিয়েছে কখনও ‘অভিষেক’ আবার কখনও ‘অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়’ নামটি।
নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কুন্তল ঘোষের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন তাঁর বেতনভুক কর্মী অরবিন্দ রায়বর্মণ। অরবিন্দ সিবিআইয়ের জেরায় দাবি করেন, কুন্তলেরই নির্দেশে সে দিনের কথোপকথন নিজের মোবাইলে লুকিয়ে রেকর্ড করেছিলেন। পরে সেই কথোপকথন নিজের ল্যাপটপে চালান করেছিলেন।
টেট দু্র্নীতির তদন্তে নেমে সেই ল্যাপটপ থেকে ওই অডিয়ো রেকর্ডিং উদ্ধার করে সিবিআই। সেই পুরো কথোপকথনটি লিখিত আকারে তৃতীয় অতিরিক্ত চার্জশিটের সঙ্গে আদালতে পেশ করেছে সিবিআই।
অরবিন্দের রেকর্ড করা কথোপকথনে তাঁর নিজের ছাড়াও গলা রয়েছে কুন্তল, সুজয়কৃষ্ণের। উপস্থিত ছিলেন সুজয়কৃষ্ণের স্ত্রী, শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় (তৃণমূলের বহিষ্কৃত নেতা এবং এজেন্ট) এবং সুরজিৎ চন্দ্র (এজেন্ট)। মাঝেমধ্যে গলা শোনা যাচ্ছিল একটি তোতাপাখির। সুজয়ের স্ত্রীর নাম ধরে মাঝেমধ্যেই ডেকে উঠছিল পাখিটি, তা-ও শোনা গিয়েছে রেকর্ডিংয়ে।
প্রসঙ্গত, ওই কথোপকথনে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নামটি আছে বলে সিবিআই তাদের চার্জশিটে উল্লেখ করেছে।অভিষেকের আইনজীবী সঞ্জয় বসু বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিলেন, সিবিআই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাঁর মক্কেলের ভাবমূর্তি নষ্ট করার মরিয়া চেষ্টা করছে। অভিষেক নিজেও নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূলের সাংগঠনিক সভা থেকে ওই বিষয়ে সিবিআইকে পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন।
কথোপকথনের শুরুতেই সুজয়কৃষ্ণের মুখে শোনা গিয়েছে অভিষেকের নাম। কথাবার্তা চলাকালীন বেশ কয়েক বার ‘সাহেব’ বলেও সুজয়কৃষ্ণ সম্বোধন করেছেন অভিষেককে। প্রসঙ্গত, সুজয়কৃষ্ণ প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন, অভিষেককে তিনি ‘সাহেব’ বলে সম্বোধন করেন। কথোপকথন শুরু হচ্ছে—
সুজয়কৃষ্ণ: ৬ লাখ, সাড়ে ৬ লাখ যে টাকা, সেই টাকার ভাগ পার্থ (চট্টোপাধ্যায়) যদি পেয়ে থাকে, অভিষেক কিছুতেই মানছে না, পার্থদা এই টাকা পেয়েছে। (কিছু ক্ষণ থেমে) তোমার.. যদি পেয়ে থাকে, পার্থদাকে (সম্ভবত ‘পার্থদার’ বলতে চেয়েছেন) অভিষেককে বলা উচিত না, তোর কাজগুলো করে দিলাম..।
প্রসঙ্গত, সিবিআইকে দেওয়া বয়ানে অরবিন্দ দাবি করেছেন, প্রাথমিকে শিক্ষকের চাকরি দেওয়ার পরিবর্তে শান্তনু-কুন্তল যে ‘ঘুষ’ (প্রায় সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা করে) নিতেন, তার একটা অংশ গিয়েছিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। তা জানতে পেরেছিলেন অভিষেক। অরবিন্দের বক্তব্য, সুজয় দাবি করেছিলেন, পার্থের কাছে ওই টাকার একটা অংশ যাচ্ছে জানতে পেরে নিজের ‘ভাগ’ দাবি করেছিলেন অভিষেক।
সিবিআইয়ের হাতে যে অডিয়ো এসেছে, তাতে সুজয়কৃষ্ণকে বলতে শোনা গিয়েছে, অভিষেক ১৫ কোটি টাকা দাবি করেছিলেন। সেই টাকা জোগাড় করার জন্যও কুন্তল, শান্তনুদের সঙ্গে পরিকল্পনা করছিলেন সুজয়কৃষ্ণ। ২৫০ জনের থেকে টাকা তুললে ১৫ কোটি জোগাড় করা যাবে বলে জানান সুজয়কৃষ্ণ।
সুজয়কৃষ্ণ এবং বাকিদের কথোপকথনে ১৫ কোটি ছাড়াও একাধিক প্রসঙ্গে অভিষেকের নাম উঠে এসেছে। কখনও তিনি হুগলির চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। কখনও সুজয়কৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে অভিষেকের পুরনো সম্পর্ক ব্যাখ্যা করেছেন। সুজয়কৃষ্ণের এক আত্মীয় বিপদে পড়লে বজবজের বেসরকারি স্কুলে অভিষেক ওই আত্মীয়ের চাকরির বন্দোবস্তও করে দিয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন সুজয়। প্রসঙ্গত, বজবজ অভিষেকের লোকসভা কেন্দ্র ডায়মন্ড হারবারের অন্তর্গত। তবে কিছু ক্ষেত্রে সুজয়কৃষ্ণ অভিষেককে লুকিয়ে কাজ করেছেন বলেও জানিয়েছেন ওই কথোপকথনে।
অডিয়োটির মোট ২৩ পাতার সিবিআই-কৃত প্রতিলিপি হাতে পাওয়া গিয়েছে। প্রথম পাতায় চার বার, তৃতীয় পাতায় চার বার, চতুর্থ পাতায় এক বার, ষষ্ঠ পাতায় দু’বার, সপ্তম পাতায় তিন বার, অষ্টম পাতায় দু’বার, নবম পাতায় দু’বার, দশম পাতায় ১৫ বার অভিষেকের নাম রয়েছে। এ ছাড়া, ১১ নম্বর পাতায় ছ’বার, ১২ নম্বর পাতায় দু’বার, ১৫ নম্বয় পাতায় তিন বার, ১৬ নম্বর পাতায় তিন বার, ১৮ নম্বর পাতায় আট বার, ২০ নম্বর পাতায় সাত বার, ২১ নম্বর পাতায় ১০ বার এবং ২২ নম্বর পাতায় এক বার এই নাম এসেছে।
সুজয়কৃষ্ণ: কালীঘাট অফিসে ঢুকে অভিষেক বলল, ১৫ কোটি টাকা দিয়ে দাও। আমি বললাম, স্যর, টাকা কেউ দেবে না। দু’বার করে কি টাকা দেবে? সাড়ে ছ’লক্ষ করে টাকা দিয়েছে, আবার টাকা দেবে!.. অভিষেক বলেছে, কারা এটা করেছে নাম দাও আমাকে। এ বার আমি দেখো, এবার আমি তো কোনও ভাবেই কুন্তল, অরবিন্দের নামটা বলব না। এটা তো গ্যারান্টি। আমি তো এই জন্য বলছি একবার দেখা করতে। এ বার ওকে বুঝিয়ে বললাম দুটো, দেখো এই এই ব্যাপার।
সুজয়কৃষ্ণ (আবার কিছু পরে): আমি না বলছি না। এখন এটা থেকে সমাধানের একটা উপায়— অভিষেক রাফলি ১৫ কোটিতে খুশি। শান্তনু, অভিষেক ১৫ কোটিতেই খুশি। এখন ২৫০ লোক করলে ১৫ কোটি পেয়ে যাব। ঠান্ডা মাথায় মন দিয়ে বলো। আমি ২৫০ লোক করলে ১৫ কোটি পেয়ে যাব।.. শুধু মানিক ভট্টাচার্য কাজটা করবে। মানিক ভট্টাচার্য জানবে। পার্থ চ্যাটার্জির মুখে সেলোটেপ মেরে দেবে। অভিষেক ব্যানার্জির জানার স্কোপ জ়িরো (সুযোগ শূন্য)।
সুজয়কৃষ্ণ (আত্মীয়ের চাকরি প্রসঙ্গে): আমি গাড়ি পাঠাতাম এয়ারপোর্টে। অভিষেক তিন দিন কলকাতায় থাকলে তিন দিন ওঁর বাড়িতে গাড়ি লেগে থাকত। ড্রাইভার, তেল-সহ। ঠিক আছে? …আমার শালির স্বামী মারা যেতে অভিষেক ফোন করে বলল, ”কালকে বায়োডাটাটা দিয়ে দাও।” মিথ্যা কথা বলব না, বজবজের একটা স্কুলে চাকরি করে দিয়েছে।
তথ্য – আনন্দবাজার পত্রিকা