সমাজে শান্তি, সাম্য ও সহনশীলতা বজায় রাখতে হলে ঘৃণা ও ধর্মীয় বৈষম্যের (Stop Hatred-Religious discrimination) মতাদর্শ থেকে আমাদের মুক্ত থাকতে হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা আজও এমন প্রবণতার সাক্ষী হচ্ছি, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে নৃশংস আক্রমণকারীদের মহিমান্বিত করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের এক চলচ্চিত্র পরিবার তাদের সন্তানের নাম রেখেছে তৈমুর, যে ১৩৯৮ সালে ভারত আক্রমণ করেছিল। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল সেই মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, যারা তার মতে, হিন্দুদের প্রতি যথেষ্ট কঠোর ছিলেন না। এ ধরনের মানসিকতা শুধুমাত্র অতীতের সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেয় না, বরং বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। আমরা যদি সত্যিই শান্তি ও সম্প্রীতির সমাজ গড়তে চাই, তাহলে অতীতের বিভাজনমূলক ইতিহাসকে গৌরবময় করে দেখার প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিককালে ধর্মের নামে বৈষম্য ও সহিংসতার ঘটনাও বেড়েই চলেছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ব্যাংকসটাউন হাসপাতালে কর্মরত দুই স্বাস্থ্যকর্মীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগ উঠেছে। তারা চিকিৎসাধীন ইহুদি রোগীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এবং তাদের প্রতি অবিচার করার কথা স্বীকার করেছেন। এমন কর্মকাণ্ড কেবল পেশাগত নৈতিকতাকেই কলঙ্কিত করে না, বরং এটি সমাজের মধ্যে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দেয়।
ধর্মীয় বিদ্বেষ কেবল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়। ইউরোপ ও আমেরিকাতেও ইহুদিদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। নেদারল্যান্ডসে ইহুদিদের ওপর হামলার হার ২৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, ব্রিটেনে ৫৫০টির বেশি ইহুদি-বিরোধী ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে, এবং ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও এমন প্রবণতা দেখা গেছে। যদিও অনেকে এসব ঘটনাকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংঘাতের সাথে যুক্ত করেন, বাস্তবে ইহুদিবিদ্বেষের শিকড় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গভীরে প্রোথিত।
ধর্মীয় নির্যাতনের ইতিহাসে শুধু ইহুদিরাই ভুক্তভোগী নয়। ভারতের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। আরব আক্রমণকারী মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পর থেকে ভারতের মূল সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর ধারাবাহিক আঘাত এসেছে। গজনী, ঘোরি, তৈমুর, খিলজি, তুঘলক, আওরঙ্গজেব এবং টিপু সুলতানের মতো শাসকেরা ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের চেষ্টা করেছেন। দক্ষিণ ভারতে খ্রিস্টান মিশনারি ফ্রান্সিস জেভিয়ারের প্রচেষ্টায় ‘গোয়া ইনকুইজিশন’-এর মাধ্যমে হিন্দু ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা চালানো হয়েছিল। এমনকি স্বাধীনতার পরেও ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করা অব্যাহত রয়েছে।
আজকের দিনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই ঘৃণা ও বৈষম্যের মনোভাবকে রোধ করা। ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা এবং ধর্মীয় বা জাতিগত বিভাজন সৃষ্টিকারী প্রচার আমাদের সমাজকে আরও বিভক্ত করে তুলছে। এই প্রবণতা রুখতে হলে শিক্ষার প্রসার ঘটানো, সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি করা এবং সত্য ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়োজন।
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ঘৃণা কখনও ঘৃণার অবসান ঘটাতে পারে না। শুধু ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং পারস্পরিক সম্মানই পারে এই চক্র ভাঙতে। অতএব, আমাদের উচিত ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এমন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা, যেখানে সব সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে থাকতে পারে।