Transparency in voter lists: গণতন্ত্র রক্ষায় ভোটার তালিকায় স্বচ্ছতা অপরিহার্য

সম্পাদকীয়ঃ আমাদের দেশের গণতন্ত্র আজ এক গুরুতর সংকটের মুখে। যখন দেশের প্রতিটি নাগরিকের নাম ভোটার তালিকায় থাকা উচিত (Transparency in voter lists),তখন বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভোট দেওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর এক বিরাট কলঙ্ক। এই সমস্যা শুধু একটি আইনগত ত্রুটি নয়, এটি আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে, দেশের পূর্ব সীমান্তে এই সমস্যা অত্যন্ত প্রকট এবং এটি দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের জন্ম দিয়েছে।

বিগত কয়েক বছর ধরে, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) নিয়ে যে রাজনৈতিক বিতর্ক দেখা দিয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে বিরোধীরা এই সমস্যার সমাধানে একমত হতে নারাজ। তারা এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে যেখানে অনুপ্রবেশকারী এবং প্রকৃত শরণার্থীদের মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই রাজনৈতিক বিভাজন দেশের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।

সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকার বিশেষ (Transparency in voter lists) সংশোধন নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে, তা এই সমস্যার গভীরতা আরও একবার সামনে এনেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে বিহারের অনেক জেলায় আধার কার্ডের সংখ্যা জনসংখ্যার চেয়ে বেশি, বিশেষত মুসলিম অধ্যুষিত সীমাঞ্চল জেলাগুলিতে। যদিও কিছু লোক আদমশুমারির পুরানো তথ্যের কারণে এই পার্থক্যকে স্বাভাবিক বলে মনে করে, কিন্তু ১৫-২০ শতাংশের বেশি পার্থক্য নিঃসন্দেহে উদ্বেগের বিষয়। এটি শুধু বিহারের সমস্যা নয়, বরং অন্যান্য রাজ্যগুলিতেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। গত বছর মুম্বাইয়ে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টার খবরও সামনে এসেছিল, যা প্রমাণ করে এই সমস্যা কতটা বিস্তৃত।

আমাদের ইতিহাস থেকে এই ধরনের অনুপ্রবেশের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে শিক্ষা নেওয়া উচিত। ১৯৭৯ সালে আসামের মঙ্গলদোই লোকসভা উপনির্বাচনের সময়, ভোটার তালিকায় ২৬,০০০ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর নাম পাওয়া গিয়েছিল। সেই সময় থেকেই নির্বাচন কমিশন বিদেশিদের নাম বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিলেও, রাজনৈতিক চাপে তা উপেক্ষা করা হয়েছিল। তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস.এল. শক্তিধর নিজেই অভিযোগ করেছিলেন যে একটি রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বিদেশিদের নাম ভোটার তালিকায় যুক্ত করছে। সেই সময়ে আসামের নির্বাচনী ফলাফলও এই অভিযোগকে সমর্থন করেছিল। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে যখন সারা উত্তর ভারতে কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল, তখন তারা আসামের ১৪টি আসনের মধ্যে ১০টিতে জয়লাভ করেছিল, যা সন্দেহজনক ভোটদাতাদের সহায়তার দিকে ইঙ্গিত করে।

পরবর্তীকালে, অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (AASU) এই কারচুপির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনের উত্তাল সময়ে একজন অনুপ্রবেশকারীর সহায়তায় নির্বাচিত বিধায়ককে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়, যা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তার প্রথম কাজই ছিল ভোটার তালিকা থেকে বিদেশিদের শনাক্তকরণ বন্ধ করা। এর ফলে আসামে সহিংসতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ মারাত্মক রূপ নেয়।

শুধু আসাম নয়, পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্যেও অনুপ্রবেশকারীরা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করছে। প্রায় ২৫ বছর আগের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে বাংলার ২৯২টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৫২টি আসনে অনুপ্রবেশকারীরা নির্ণায়ক ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে অনুমান করা যায়। তৃণমূল নেত্রী লাভলী খাতুনের বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার ঘটনা এবং দলের অন্যান্য নেতার বিতর্কিত মন্তব্য এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে।

এই পরিস্থিতিতে, কেন্দ্র এবং নির্বাচন কমিশনকে সমস্ত রাজনৈতিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। ভোটার তালিকায় স্বচ্ছতা আনা এবং বিদেশিদের নাম বাদ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এটি শুধু দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার শুদ্ধতা নিশ্চিত করবে না, বরং আমাদের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার জন্যও অপরিহার্য। পাশাপাশি, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র যাতে এই পদক্ষেপকে ব্যর্থ করতে না পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। আমাদের গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এবং দেশের ভবিষ্যতের সুরক্ষায় এই পদক্ষেপগুলি আজ একান্ত প্রয়োজন।

Exit mobile version