কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী কর্তৃক ২০২৪ সালের হরিয়ানা নির্বাচনের ‘ভোট চোরি’-র “প্রমাণ” হিসেবে তথাকথিত ‘এইচ-ফাইল'(‘Vote Chori’ Drama Exposed) উপস্থাপনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইযোগ্য তথ্যের সামনে টিকতে পারল না। নির্বাচনী কারচুপির দাবির মূলে ছিল ভুল তথ্য এবং প্রশাসনিক পদ্ধতির ইচ্ছাকৃত বিকৃতি।
‘এইচ-ফাইল’ অভিযোগের নেপথ্যে কী?
সাম্প্রতিক এক চাঞ্চল্যকর সংবাদ সম্মেলনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী ২০২৪ সালের হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে ব্যাপক ‘ভোট চোরি’(‘Vote Chori’ Drama Exposed) বা ভোট চুরির অভিযোগ আনেন। তিনি এটিকে ‘এইচ-ফাইল’ (H-File) নাম দিয়ে দাবি করেন, এটি একটি সুপরিকল্পিত নির্বাচনী ষড়যন্ত্রের উন্মোচন। অভিযোগের কেন্দ্রে ছিল একটি নির্দিষ্ট দাবি: হরিয়ানার ভোটার তালিকায় একজন বয়স্ক ভোটারের নাম ২২০ বার প্রকাশিত হয়েছে, যা ব্যাপক নকল ও কারচুপির স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
তবে, পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইয়ের পর দেখা যাচ্ছে, রাহুল গান্ধীর এই ‘এইচ-ফাইল’-এর প্রতিটি অভিযোগই শক্তিশালী, যাচাইযোগ্য তথ্যের ভারে ভেঙে পড়ছে। নির্বাচনী কারচুপির প্রমাণের পরিবর্তে, এটি ভুল তথ্যের একটি সুপরিকল্পিত প্রচারণার চিত্র তুলে ধরেছে।
প্রধান অভিযোগের অসঙ্গতি: ২২০ বার ভোটারের নাম রহস্যের সমাধান
রাহুল গান্ধীর সংবাদ সম্মেলনের সবচেয়ে হাস্যকর এবং কেন্দ্রীয় দাবিটি ছিল হরিয়ানার মুলানা বিধানসভা কেন্দ্রের ঢাকোলা গ্রামের ৬৩ নম্বর বুথে “বহু ভোট” সম্পর্কিত। তিনি নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করেছিলেন যে একটি ভোটকেন্দ্রে ২২০টি একই রকম এন্ট্রি পাওয়া গেছে, যা জালিয়াতির স্পষ্ট ইঙ্গিত।“নির্বাচন কমিশনকে আমাদের জানাতে হবে যে এই মহিলা… লোকসভা নির্বাচনে, তিনি একটি বুথে ২২৩ বার উপস্থিত ছিলেন এবং তারপরে তারা এটিকে দুটি বুথে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
বাস্তবতা কী ছিল? প্রশাসনিক পদ্ধতির বিকৃতি
রাহুল গান্ধী ৬৩ নম্বর বুথের কথা উল্লেখ করছিলেন। কিন্তু, নির্বাচন কমিশনের আদর্শ পদ্ধতি অনুযায়ী, কোনো বুথে ভোটার সংখ্যা নির্ধারিত সীমা (সাধারণত ১৪০০-১৫০০) অতিক্রম করলে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য সেটির সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়।
- এই পদ্ধতিতেই ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য ঢাকোলার সেই ৬৩ নম্বর বুথটিকে ৬৩ এবং ৬৪ নম্বর বুথে বিভক্ত করা হয়েছিল। ২০১৯ সালে এটি একক বুথ ছিল।
- গান্ধী যাকে “দ্বিগুণের প্রমাণ” হিসাবে চিত্রিত করেছিলেন, তা আসলে ভোটকেন্দ্রের সীমানা পুনর্নির্ধারণের একটি সাধারণ প্রশাসনিক পদ্ধতি। এটি ভারত জুড়ে প্রতিটি বড় নির্বাচনের আগে নিয়মিতভাবে ঘটে।
অর্থাৎ, ২২০ বার একই নামের পুনরাবৃত্তি নয়, বরং এটি ছিল একটি পুরাতন বুথের ভোটারদের সুবিধার্থে দুটি নতুন বুথে ভাগ করে দেওয়ার প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফল। এই সরল প্রশাসনিক সত্যকে ‘ভোট চোরি’র প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
স্ববিরোধিতার চূড়ান্ত উদাহরণ: ‘কারচুপি’ সত্ত্বেও জয়ী কংগ্রেস!
রাহুল গান্ধীর অভিযোগের অযৌক্তিকতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন বুথের নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়।
আশ্চর্যজনকভাবে, গান্ধী তার তথাকথিত কারচুপির “প্রমাণ” হিসেবে যে মুলানা নির্বাচনী এলাকা থেকে তালিকাটি তুলে ধরেছিলেন, সেই আসনেই কংগ্রেস দল জয়লাভ করেছে!
- ২০২৪ সালের লোকসভা এবং বিধানসভা নির্বাচনে ঢাকোলা গ্রামের ভোটাররা কংগ্রেসের পক্ষেই নির্ণায়ক ভোট দিয়েছিলেন।
- ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে, কংগ্রেস এই এলাকায় তার ভোটের ভাগ উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছে এবং বিজেপিকে ছাড়িয়ে গেছে।
- ঢাকোলা বুথে বিজেপির ভোটের হার প্রায় অর্ধেক কমে গিয়েছিল।
যদিও পরিলক্ষিত হল যে, নির্বাচনী পদ্ধতিকে কারচুপির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, সেই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে একটি আসনে নিজের দলের জয়লাভের প্রমাণকে কারচুপির ‘প্রমাণ’ হিসেবে উপস্থাপন করা কেবল যুক্তির পরিপন্থীই নয়, হাস্যকরও বটে। এটি রাহুল গান্ধীর সম্পূর্ণ যুক্তির ভিত্তি এবং ‘এইচ-ফাইল’-এর বিশ্বাসযোগ্যতাকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করে দেয়।
‘এইচ-ফাইল’ – ভুল তথ্যের এক ব্যর্থ প্রচেষ্টা
রাহুল গান্ধীর ‘ভোট চোরি’র নাটকটি নির্বাচনী কারচুপির একটি উন্মোচন হওয়ার পরিবর্তে, এটি এমন এক রাজনৈতিক কৌশলের প্রকাশ যা যাচাইযোগ্য তথ্যকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র ভুল ধারণা এবং ইচ্ছাকৃত বিকৃতির উপর নির্ভর করে। তথাকথিত ‘এইচ-ফাইল’ শেষ পর্যন্ত নিজেই ভুল তথ্যের ভারে ভেঙে পড়ল, যা নির্বাচনী বিতর্ককে তথ্য-ভিত্তিক আলোচনার পরিবর্তে ভিত্তিহীন অভিযোগের দিকে ঠেলে দেওয়ার একটি ব্যর্থ প্রচেষ্টা মাত্র।










