কলকাতার আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারকে ধর্ষণ ও খুনের(RG Kar Doctor Death) ঘটনায় গোটা রাজ্যে তোলপাড় চলছে, তবে ধর্ষণ-খুন নিয়ে বাংলায় এত বড় তোলপাড় এই প্রথম নয়। এর আগেও নারী নির্যাতন নিয়ে রাজ্যের রাজনীতিতে তোলপাড় হয়েছে। আসুন জেনে নেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনের ১০টি বড় মামলা।
কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের এক জুনিয়র চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের (RG Kar Doctor Death) ঘটনায় তোলপাড় চলছে। কলকাতা পুলিশ এই মামলায় একজন অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করেছে, তবে বিরোধী দলগুলি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে আরও অভিযুক্তকে বাঁচানোর অভিযোগ করছে। লাগাতার কর্মবিরতি ও বিক্ষোভ চলছে। বিচারের দাবিতে চিকিৎসকরাও কর্মবিরতিতে সামিল হয়েছেন। প্রশ্ন উঠছে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে। বিষয়টি হাইকোর্টে পৌঁছলে আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। এখন এই বিষয়ে সিবিআই তদন্ত শুরু করেছে, কিন্তু অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলার রাজনীতি উত্তপ্ত।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে একটি সমাবেশ করেছেন। তাই বাংলা বনধের ডাক দিয়েছে এসইউসিআই। বিজেপি ও বামেরাও শুক্রবার দিনভর বিক্ষোভ অব্যাহত রেখেছে।
এটিই প্রথম নয় যে ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৩ বছরের শাসনকালে এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি যা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তবে এখনও অবধি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১৩ বছরের শাসনামলে, ধর্ষণ এবং খুনের মতো ১০টি বড় মামলা হয়েছে, যা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছিল। আসুন জেনে নেওয়া যাক সেই মামলাগুলো-
১. পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলা (২০১২)
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে, সুজেট জর্ডান নামে এক মহিলা কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে একটি নাইট ক্লাব থেকে বের হওয়ার পর চলন্ত গাড়িতে গণধর্ষণের শিকার হন। প্রাথমিকভাবে পুলিশ এটিকে একটি বানোয়াট গল্প বলে উড়িয়ে দিলেও মামলাটি নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে হামলাকারীদের শেষ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয় এবং দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার এক বছর পর এই ঘটনা ঘটল। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলা নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্যও শিরোনামে এসেছে। এ নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় হয়। মামলাটি মহিলাদের নিরাপত্তার প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাব এবং ভুক্তভোগীদের বিশ্বাস করতে কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক অনীহা প্রকাশ করে।
২. কামদুনি গণধর্ষণ ও হত্যা (২০১৩)
জুন ২০১৩: তারিখ ৭ জুন। বুধবার ছিল সেদিন। বৃষ্টি নেমেছিল বাংলায়। ওই দিন বিকেলে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন ডিরোজিও কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কামদুনি বাসস্ট্যান্ডে তাঁকে নিতে তাঁর ভাইয়ের যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি আসতে দেরি করেছিলেন। তাই ওই তরুণী একাই বাড়ির ফেরার পথ ধরেন। কিন্তু ফেরা হয়নি। কারণ ওই তরুণীকে টেনেহিঁচড়ে পরিত্যক্ত একটি মাঠে নিয়ে যায় ৯ দুষ্কৃতী। সেখানে ওই তরুণীকে ধর্ষণ করা হয়। মাঝরাতে ওই মাঠে মেলে তরুণীর ব্যাগ। আর মেলে ওই তরুণীর ছিন্নভিন্ন দেহ। লাগাতার ধর্ষণ করার পর দুষ্কৃতীরা তাঁর দেহ চিরে দেয় নাভি পর্যন্ত। এই ঘটনায় কেঁপে ওঠে বাংলা। অপরাধের নৃশংসতা সারা দেশকে হতবাক করেছিল। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। পরে বিষয়টি হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টে যায়।
৩. মধ্যমগ্রাম ধর্ষণ মামলা (২০১৩)
অক্টোবর ২০১৩: উত্তর ২৪ পরগণা জেলার মধ্যমগ্রামে একটি ১৬বছর বয়সী কিশোরীকে দুই দিনে দুবার গণধর্ষণ করা হয়েছিল। অভিযোগ দায়ের করার পর, ভিকটিম এবং তার পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং পরে তাকে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।মামলাটি ভিকটিমদের নিরাপত্তা এবং যারা অপরাধের রিপোর্ট করার সাহস জুগিয়েছিল তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই মামলা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়।
৪. যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শ্লীলতাহানির মামলা (২০১৪)
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করা হয়েছিল। প্রশাসনের কথিত নিষ্ক্রিয়তা ব্যাপক বিক্ষোভের দিকে পরিচালিত করে, যেটিকে “হক কলরোব” আন্দোলনের নাম দেওয়া হয়েছিল এই বিক্ষোভটি যৌন সহিংসতার শিকারদের জন্য প্রতিরোধের এবং ন্যায়বিচারের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। রাজ্য জুড়ে ছাত্ররা এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিল এবং ব্যাপক আন্দোলন হয়েছিল।
৫. গঙ্গনাপুর ধর্ষণ ও হত্যা মামলা (২০১৫)
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার গাংনাপুরে একটি কিশোরীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ হয়। এই মামলাটি রাজ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার বিষয়টিকে আরও তুলে ধরেছে।
৬. বামনঘাটা ধর্ষণ মামলা (২০১৭)
জুলাই ২০১৭: দক্ষিণ ২৪পরগনা জেলার বামনঘাটায় এক মহিলাকে গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। এই মামলাটি এই অঞ্চলে নারীর প্রতি চলমান সহিংসতাকে তুলে ধরেছিল। এই ঘটনাটি মহিলাদের জন্য আরও ভাল আইন প্রয়োগ এবং সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
৭. সন্দেশখালী ধর্ষণ মামলা (২০২০)
২০২০ সালের অক্টোবরে, উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সন্দেশখালিতে একটি নাবালিকা গণধর্ষণ করা হয়েছিল। স্থানীয় যুবকের এ অপরাধে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে এবং দ্রুত বিচারের দাবি উঠেছে। এই বিষয়টি নিয়ে রাজ্য জুড়ে প্রচুর হৈচৈ হয়েছিল এবং যেহেতু এই মামলাটি ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে হয়েছিল। এ কারণে নির্বাচনের আগে এ নিয়ে তুমুল রাজনীতি হয়।
৮. হাঁসখালী ধর্ষণ ও হত্যা মামলা (২০২২)
২০২২ সালের এপ্রিলে, নদীয়া জেলার হাঁসখালিতে একটি ১৪ বছর বয়সী মেয়েকে গণধর্ষণ এবং খুন করা হয়েছিল বলে অভিযোগ। অপরাধীদের রক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের অভিযোগে এ ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অভিযোগ করা হয়, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি এবং বিষয়টি জানাজানি হলে নিহতকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। মামলাটি ফৌজদারি তদন্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং রাজ্যে অল্পবয়সী মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
৯. ডায়মন্ড হারবার গ্যাং রেপ কেস (২০২৩)
২০২৩ সালের জুনে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার ডায়মন্ড হারবারে একদল পুরুষের দ্বারা এক মহিলাকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল। এ ঘটনায় প্রতিবাদ ও দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের রাজনীতিও উত্তপ্ত ওঠে।
১০. কলকাতার আরজি কর মেডিকেল কলেজ ধর্ষণ হত্যা মামলা (২০২৪)
গত ৮ আগস্ট, নাইট শিফট করছিলেন তরুণী পিজিটি চিকিৎসক। পরদিন সকালে সেমিনার হল থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয়। সেই সময় বিবস্ত্র অবস্থায় ছিলেন তরুণী। এই ঘটনায় পুলিশ সঞ্জয় রায় নামে এক সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেপ্তার করে। বর্তমানে কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশে এই ঘটনার তদন্ত করছে সিবিআই। সঞ্জয়কে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই। এত নৃশংস ঘটনা একা সঞ্জয় ঘটাতে পারে বলে বিশ্বাস করতে পারছেন না তরুণী চিকিৎসকের বাবা-মা। তাঁদের দাবি, এই ঘটনায় হাসপাতালেরই একাধিক ব্যক্তি যুক্ত। সিবিআই সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত ৩০ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়েছে বলেও খবর।
আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে লাগাতার আন্দোলন চালাচ্ছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। শিকেয় উঠেছে রোগী পরিষেবা। সেখানকার চিকিৎসকরা বলছেন, পুলিশ মাত্র একজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার র করেছে, যেখানে এই জঘন্য ঘটনার সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত থাকতে পারে। তাঁদের দাবি, অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতারের পিছনে পরিকল্পিতভাবে বড় কিছু আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন তদন্ত শেষ করতে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। সেই সঙ্গে দেশব্যাপী বিক্ষোভের হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে।