চাঁদের বয়স (Age of the Moon) নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক রয়েছে, তবে ‘নেচার’ জার্নালে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক গবেষণা এই বিতর্ককে নতুন দিশা দিয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪.৫১ বিলিয়ন বছর আগে চাঁদের সৃষ্টি হয়েছিল। একটি পূর্ববর্তী গবেষণা অনুসারে, চাঁদের বয়স ৪.৩৫ বিলিয়ন বছর থেকে প্রায় ১০০ মিলিয়ন বছর বয়সী বলে মনে করা হয়েছিল। এই নতুন গবেষণা কেবল চাঁদের ইতিহাসই পরিবর্তন করবে না, সৌরজগতের প্রথম দিকের দিনগুলি সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে, ‘পুনরায় গলন’ প্রক্রিয়াটি চাঁদ গঠনের বয়স নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রান্সিস নিমো এবং তাঁর দল আবিষ্কার করেছেন যে পৃথিবীর মহাকর্ষীয় শক্তি চাঁদের শিলাগুলিতে বড় পরিবর্তন ঘটিয়েছে, যা তাদের “ভূতাত্ত্বিক ঘড়ি” সময়কে প্রভাবিত করে। এটি ঘটেছিল যখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ চাঁদের (Age of the Moon) অভ্যন্তরকে উষ্ণ করে এবং পাথরগুলিকে আবার গলিয়ে দেয়।
পুরনো ধারণাগুলি নিয়ে প্রশ্ন
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ৪.৩৫ বিলিয়ন বছর আগে একটি বিশাল সংঘর্ষের ফলে চাঁদ তৈরি হয়েছিল। এটি ‘জায়ান্ট ইমপ্যাক্ট হাইপোথিসিস “নামে পরিচিত। এই অনুসারে, পৃথিবী এবং মঙ্গলের আকারের একটি বস্তুর সংঘর্ষের ধ্বংসাবশেষ চাঁদ গঠন করে। অ্যাপোলো মিশন থেকে আনা নমুনার উপর ভিত্তি করে একই বয়সও অনুমান করা হয়েছিল।
তবে, একটি নতুন গবেষণা এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। পুনরায় গলনের ঘটনাটি চাঁদের শিলাগুলির বয়স পুনরায় নির্ধারণ করে, যার ফলে পুরানো পদ্ধতি দ্বারা সঠিকভাবে অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়ে।
জিরকন থেকে নতুন প্রমাণ
গবেষণায় চাঁদে পাওয়া জিরকনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। জিরকনের বয়স ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। আগে এটি চাঁদ (Age of the Moon) গঠনের সময় বলে মনে করা হত, কিন্তু এখন বিজ্ঞানীরা এটিকে চাঁদ গঠনের আগের ঘটনার প্রমাণ বলে মনে করেন।
জোয়ারের উত্তাপের প্রভাব
গবেষণা অনুসারে, চাঁদ গঠনের পর, পৃথিবীর মহাকর্ষীয় শক্তি এতে ‘জোয়ার-ভাটা উত্তাপ’ প্রক্রিয়ার জন্ম দেয়। এটি বৃহস্পতির চাঁদ আইও-তে দেখা একই প্রক্রিয়া। পৃথিবীর শক্তি চাঁদের অভ্যন্তরকে উষ্ণ করে এবং শিলাগুলিতে পরিবর্তন ঘটায়। এই প্রক্রিয়াটি চাঁদের বয়সের পুরানো অনুমানকে ব্যাহত করে।
ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
চাঁদ (Age of the Moon) গঠনের নতুন সময়রেখা ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ দিয়েছে। পুনরায় গলন এবং জোয়ার-ভাটা উত্তাপের নীতিগুলি বিজ্ঞানীদের বুঝতে সাহায্য করেছে যে কেন চাঁদের খনিজগুলি তার প্রকৃত বয়সের চেয়ে অনেক বেশি পুরানো।
বহু দশক ধরে চাঁদের বয়স সম্পর্কে বিভিন্ন তত্ত্ব ছিল। অ্যাপোলো মিশনের নমুনাগুলি 4.35 বিলিয়ন বছর বয়সী চাঁদের সমর্থন করেছিল। কিন্তু নিম্মো এবং তার দলের গবেষণা এই সময়সীমা 4.51 বিলিয়ন বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই আবিষ্কার পুরনো দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছে এবং একটি স্পষ্ট চিত্র উপস্থাপন করেছে।
চাঁদ নিয়ে অধ্যয়নের গুরুত্ব
চাঁদের গঠন ও বিবর্তন নিয়ে গবেষণা ভবিষ্যতের মহাকাশ গবেষণার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিনের চ্যাং-৬ এবং নাসার আর্টেমিস প্রোগ্রামের মতো মিশনগুলি আগামী দিনগুলিতে নতুন নমুনা এবং তথ্য সরবরাহ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে বিজ্ঞানীরা চাঁদের বয়স (Age of the Moon) এবং ভূতাত্ত্বিক বিবর্তন সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে পারবেন।
সোলার সিস্টেমের ইতিহাসে প্রভাব
চাঁদের গঠনের নতুন সময়সীমা সৌরজগতের প্রথম দিকের ঘটনাগুলিকে আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে। জার্মানির কোলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক কার্স্টেন মুঙ্কারের মতে, “সৌরজগতের উৎপত্তি বোঝার জন্য চাঁদের ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ।”
নতুন গবেষণার গুরুত্ব
যদিও ৪.৩৫ এবং ৪.৫১ বিলিয়ন বছরের মধ্যে পার্থক্যটি সামান্য বলে মনে হতে পারে, তবে এই পার্থক্যটি সৌরজগতের বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে একটি বড় পার্থক্য আনতে পারে। নতুন টাইমলাইন বিজ্ঞানীদের বুঝতে সাহায্য করবে কিভাবে গ্রহ এবং তাদের চাঁদ গঠিত হয়েছিল।
নতুন চন্দ্র টাইমলাইন বিজ্ঞানীদের সেই প্রক্রিয়াগুলি পুনরায় ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিয়েছে যা সৌরজগত গঠনের দিকে পরিচালিত করেছিল। চাঁদের (Age of the Moon) উৎপত্তি বোঝার মাধ্যমে, কেউ কেবল পৃথিবীর প্রাথমিক ইতিহাসই নয়, সমগ্র সৌরজগতের উৎপত্তি সম্পর্কেও রহস্য উন্মোচন করতে পারে।
এই গবেষণাটি কেবল চাঁদের প্রকৃত বয়সই প্রকাশ করে না, বরং প্রমাণ করে যে বিজ্ঞানীরা সময়ের সাথে সাথে পুরানো তথ্যগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন অনুসন্ধানের প্রস্তাব দিতে পারেন।