একদিকে, পাকিস্তানের সাথে ভারতের (India Pakistan Conflict) সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে, ভারতের সবচেয়ে বড় কৌশলগত অংশীদার আমেরিকার মনোভাব নিরপেক্ষ বলে মনে হচ্ছে। আমেরিকা পহেলগাম হামলার নিন্দা করছে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধির কথাও বলছে, তবে তাদের মূল জোর দুই দেশের মধ্যে সরাসরি আলোচনা শুরু করার উপর।
ডিজিটাল ডেস্ক, শ্রীনগর: ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা (LOC) জুড়ে গত তিন দিন ধরে অভূতপূর্ব উত্তেজনা বিরাজ করছে। একদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লাগাতার গুলিবর্ষণ, অন্যদিকে আকাশসীমায় রহস্যময় ড্রোন অনুপ্রবেশ পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত অংশীদার আমেরিকার আপাত নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। যদিও আমেরিকা পহেলগাম হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির কথা বলেছে, তাদের প্রধান জোর কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সরাসরি আলোচনা শুরুর উপর।
বুধবার রাত থেকে ভারতীয় সীমান্ত লাগাতার পাকিস্তানি গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে, যখন জম্মু, সাম্বা, পাঠানকোট এবং জয়সলমীরের আকাশে একের পর এক পাকিস্তানি ড্রোন দেখা যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে আকাশেই এই ড্রোনগুলোকে গুলি করে ভূপাতিত করে। নিরাপত্তার খাতিরে জম্মুর বিভিন্ন এলাকায় সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট জারি করা হয়েছে এবং শোনা যাচ্ছে সাইরেনের একটানা আওয়াজ। একই চিত্র দেখা গেছে রাজস্থানের জয়সলমীর, বারমের এবং শ্রীগঙ্গানগরেও, যেখানে ব্ল্যাকআউট জারি করা হয়েছে।
২৬টি স্থানে পাকিস্তানি ড্রোনের আনাগোনা:
উত্তরের বারামুল্লা থেকে শুরু করে দক্ষিণের ভুজ পর্যন্ত বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সীমান্ত এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর মোট ২৬টি স্থানে পাকিস্তানি ড্রোনের উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সন্দেহভাজন সশস্ত্র ড্রোন ছিল, যা বেসামরিক ও সামরিক উভয় লক্ষ্যবস্তুর জন্যই বড়সড় হুমকি তৈরি করতে পারত। চিহ্নিত স্থানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বারামুল্লা, শ্রীনগর, অবন্তিপোরা, নাগরোটা, জম্মু, ফিরোজপুর, পাঠানকোট, ফাজিলকা, লালগড় জট্টা, জয়সালমির, বারমের, ভুজ, কুয়েরবেট এবং লাখী নালা।
সূত্রের খবর অনুযায়ী, ভারতীয় অ্যান্টি-ড্রোন সিস্টেম ইতিমধ্যেই ৩ থেকে ৪টি ড্রোন ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে।
ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দে কাঁপছে সীমান্ত এলাকা:
শুক্রবার রাত ৯টায় ব্ল্যাকআউটের ঠিক ৪ মিনিট পর ফাজিলকার আকাশে রহস্যময় উজ্জ্বল আলো দেখা যায় এবং এর পরপরই একের পর এক বিকট শব্দ শোনা যায়। শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে এর প্রতিধ্বনি আশেপাশের বহু গ্রামে স্পষ্ট ভাবে অনুভূত হয়েছে।
জম্মুতে শোনা যাচ্ছে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের শব্দ। একইসঙ্গে সাম্বা থেকেও ভেসে আসছে বিস্ফোরণের আওয়াজ। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ব্ল্যাকআউটের সময় ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী পাকিস্তানি ড্রোনগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করলে সাম্বায় এই বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। জম্মু বিভাগের উধমপুরেও সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট জারি করা হয়েছে এবং সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
শ্রীনগরেও ব্ল্যাকআউট:
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে শ্রীনগরের মসজিদগুলোর লাউডস্পিকার ব্যবহার করে স্থানীয় বাসিন্দাদের দ্রুত আলো নিভিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। এরপর পুরো শ্রীনগরে ব্ল্যাকআউট জারি করা হয়।
ফিরোজপুরে বাড়ির উপর ভেঙে পড়ল ড্রোন, আহত ৩:
ফিরোজপুরে একটি ভূপাতিত ড্রোন একটি বাড়ির উপর ভেঙে পড়ে। এর ফলে বাড়িতে আগুন লেগে যায় এবং তিনজন গুরুতরভাবে দগ্ধ হন। আগুনে একটি গাড়িও ভস্মীভূত হয়েছে। দগ্ধ লক্ষবিন্দর সিং, তার স্ত্রী এবং ছেলেকে দ্রুত একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জম্মু, পাঞ্জাব ও রাজস্থানের ২০টি স্থানে ড্রোন হামলা:
বিভিন্ন সূত্রে খবর, পাকিস্তান ইতিমধ্যেই জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব এবং রাজস্থানের প্রায় ২০টি স্থানে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। তবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ায় বহু ড্রোন মাঝ আকাশেই ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে।
পাঞ্জাবের একাধিক শহরে একটানা বিস্ফোরণ:
অমৃতসরের মোহকামপুরা এলাকায় ড্রোন হামলার মাধ্যমে আনা বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এই ঘটনায় এলাকায় তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
কাশ্মীর উপত্যকায় সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট:
কাশ্মীর উপত্যকাতেও ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটেছে। দক্ষিণ কাশ্মীরের আওন্তিপোরায় একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। পুরো কাশ্মীর উপত্যকায় জারি করা হয়েছে সম্পূর্ণ ব্ল্যাকআউট। বর্তমানে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে।
গুজরাটের বনসকাঁথার ২৪টি সীমান্তবর্তী গ্রামে বিদ্যুৎ বিভ্রাট:
গুজরাটের বনসকাঁথার কালেক্টর মিহির প্যাটেল শুক্রবার গভীর রাতে জানিয়েছেন যে জেলার ২৪টি সীমান্তবর্তী গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। তিনি সকল নাগরিককে গুজবে কান না দেওয়ার এবং প্রশাসনের দেওয়া নির্দেশাবলী মেনে চলার অনুরোধ করেছেন।
নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে বসবাসকারীদের বাঙ্কারে স্থানান্তর:
পাকিস্তানি সেনাদের লাগাতার ভারী গোলাবর্ষণের ফলে কাশ্মীরের তিনটি সীমান্তবর্তী জেলার নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাঙ্কার বা অন্যান্য স্থানে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
রাজস্থানের পোখরানে বিস্ফোরণের শব্দ:
রাজস্থানের পোখরানেও শক্তিশালী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এর জেরে গোটা শ্রীগঙ্গানগর জেলায় রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে।
কর্তারপুর করিডোরের কাছে বিস্ফোরণ:
গুরুদাসপুরের কর্তারপুর করিডোরের কাছেও বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে গুরুদাসপুরের তিবরি ক্যান্টনমেন্টেও একটানা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
নাগরোটায় ১৫টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ:
জম্মু ও কাশ্মীরের নাগরোটায় পাকিস্তান ১৫টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে বলে জানা গেছে। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে আকাশেই সেই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ একটি পোস্টে নিজের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “আমি যেখানেই থাকি না কেন, বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কামানের আওয়াজও ভেসে আসছে।”
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের এই ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা regional stability-র জন্য একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, আন্তর্জাতিক মহল এই পরিস্থিতিতে কী ভূমিকা নেয় এবং দুই দেশের মধ্যে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে।