পল্লব হাজরা, কৃষ্ণনগরঃ নদিয়ার কৃষ্ণনগর মানেই শুধু মিষ্টির শহর কিংবা রাজা কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল ভাঁড়ের গল্পের শহরই নয়।নদীয়ার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান এই কৃষ্ণনগর। আর এই শহরের প্রাণকেন্দ্রে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ী, যা চারশো বছরেরও বেশি পুরনো এক দুর্গাপূজার (Durga Puja 2025) সাক্ষী। রাজবাড়ীর সিংহদ্বার থেকে শুরু করে নাটমন্দির পর্যন্ত, প্রতিটি ইঁটে মিশে আছে এক হারানো আভিজাত্যের স্পর্শ।
ঐতিহ্যের শুরু এক অলৌকিক স্বপ্নাদেশ থেকে:
রাজবাড়ির এই পুজোর নেপথ্যে রয়েছে এক অলৌকিক কাহিনি। শোনা যায়, এক দশমীর দিন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র যখন নদীপথে ফিরছিলেন, তখন তিনি দেখতে পান অসংখ্য প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। সেদিন গভীর রাতে তিনি এক দৈব স্বপ্নাদেশ পান। দেবী স্বয়ং তাঁকে নির্দেশ দেন, রাজবাড়ির দীঘিতে পাওয়া একটি প্রতিমার কাঠামোতেই তাঁর পূজা করতে হবে। কারণ রাজা ফেরার পর দীঘিতে জাল ফেললে একটি দুর্গাপ্রতিমার কাঠামো উঠে আসে। সেই স্বপ্নাদেশকে সম্মান জানিয়ে রাজা সেই কাঠামোতেই তৈরি করান মায়ের প্রতিমা এবং নাটমন্দির স্থাপন করে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর হাত ধরে রাজবাড়িতে শুরু হয় দেবী বন্দনা। দেবী এখানে পুজিত হন রাজেশ্বরী নামে। প্রায় সাড়ে চারশো বছর ধরে সেই ধারা আজও একইভাবে প্রবাহিত।
নহবতের সুর ও পূজার অনবদ্য রীতি:
রাজবাড়ির পূজার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো নহবতখানা। পূজার প্রতিটি দিন প্রহর অনুযায়ী এখানে বসে বিভিন্ন রাগের সানাই ও নাকাড়ার সুরের আসর। এই ঐশ্বরিক সুর দেবীর আগমনকে আরও মহিমান্বিত করে তোলে এবং উৎসবের পরিবেশকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দেয়। দেবী এখানে মহামায়া রূপে পুজিত হন। যোদ্ধার বেশে প্রতিমার দেহে থাকে বর্ম। সিংহের বদলে মা এখানে বিরাজমান ঘোড়ার উপর। একচালা বিশিষ্ট চালচিত্রে শোভাপায় দশম মহাবিদ্যা। শাক্ত মতে রাজবাড়িতে চলে দেবী আবাহন। এক সময় পশুবলি হলেও এখন বলি হয় চালকুমড়ো আখ।একসময় নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে ও কামান দেগে পুজোর সূচনা হলেও আজ তা অতীত।
রাজবাড়ির পূজার এক অন্যতম প্রধান অঙ্গ হলো হোমকুণ্ড। মহালয়ার দিন বোধন ঘরে প্রজ্বলিত এই হোমকুণ্ড নবমী পর্যন্ত অনির্বাণ শিখায় জ্বলতে থাকে। দেবীর ভোগেও রয়েছে এক বিশেষ ঐতিহ্য। প্রতিপদে দেবীকে নিবেদন করা হয় খিচুড়ি, পোলাও, পাঁচরকমের ভাজা, পটলের দোর্মা, চাটনি, পায়েস ও নানা ধরনের মিষ্টান্ন। মহাসপ্তমীতে মায়ের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এরপর থেকে নবমী পর্যন্ত দেবীকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। রাজমাতা অমৃতা রায় জানান, সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত নদীয়ার পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী জেলার সেরা মিষ্টিগুলিও প্রতিদিনের ভোগে যুক্ত করা হয়। নবমীর দিন মায়ের ভোগে থাকে তিন ধরনের মাছ—ইলিশ, চিংড়ি এবং রুই। দশমীর দিন দেবীকে শীতল ভোগ নিবেদন করা হয়।
বিদায় ও সিঁদুর খেলা:
দশমীতে দেবীকে নিজে হাতে বরণ করেন কৃষ্ণনগরের রানিমা অমৃতা রায়। সিঁদুর খেলা, তাঁর হাত ধরে ২০০২ সালে শুরু হয় সিঁদুর খেলা,যা আজ এক নতুন ঐতিহ্য হিসেবে রাজবাড়ির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সিঁদুরের লাল রঙে মেতে ওঠে দেবীকে বরণ করতে আসা মহিলারা। প্রথা অনুযায়ী আজও বেয়ারার কাঁধে চড়ে রাজবাড়ীর পুষ্করিণীতে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। ফের একটা বছরের অপেক্ষায় থাকে গোটা কৃষ্ণনগরবাসী।
দশমীতে দেবীকে বিদায় জানানোর সময় রাজবাড়ির সদস্যদের পাশাপাশি এলাকার মানুষও উপস্থিত থাকেন। তবে বিদায় জানানোর পর আবারও শুরু হয় এক বছরের প্রতীক্ষা। কারণ গোটা কৃষ্ণনগরবাসীর মন তখন থেকেই অপেক্ষা করতে থাকে, কবে আবার ফিরে আসবেন তাদের প্রিয় রাজ রাজেশ্বরী। এই পুজো শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, বাংলার সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং ভক্তি ও ঐতিহ্যের এক জীবন্ত উদাহরণ