খবর এইসময়,নিউজ ডেস্কঃ অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে দুই বছর তিন মাস পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে সাজার মেয়াদ শেষে নিজের দেশে ফিরলেন বাংলাদেশের এক দম্পতি। মঙ্গলবার কোলকাতা পুলিশের বিশেষ গাড়িতে চেপে ইমারজেন্সি ট্রাভেল সার্টিফিকেট নিয়ে পেট্টাপোল চেকপোস্টে এসে পৌঁছান তারা। বেলা ৩ টে নাগাদ পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদেরকে বেনাপোল ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন।
ওই দম্পতির নাম মহম্মদ মন্ডল ও মাজিদা মণ্ডল। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের খুলনা জেলার ডুমুরিয়া পঞ্চায়েতের মালতিয়া গ্রামে।
উল্লেখ্য, সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই, তাই দুই সন্তানকে দেশে রেখেই ভারতে আসার স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশি দম্পতি মহম্মদ মন্ডল ও মাজিদা মন্ডল। সেইমতো কোম্পানিতে কাজ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দালাল মারফত অবৈধভাবে সীমান্ত পেরিয়ে আড়াই বছর আগে বাংলাদেশ থেকে মহারাষ্ট্রের পুণে শহরে এসে পৌঁছয় ওই দম্পতি। কিন্তু ভারতে পৌঁছেই চরম বিপাকে পড়েন তারা। বেরিয়ে আসে দালালের আসল রূপ।
যে দালালের হাত ধরে তারা ভারতে আসেন সেই দালালই ওই বাংলাদেশি দম্পতিকে পুণের বুধওয়ার পেথ নামক একটি নিষিদ্ধপল্লী এলাকায় একটি ঘরে আটকে রাখে বলে অভিযোগ। এরই মধ্যে বাংলাদেশি নারীকে বেশ্যাবৃত্তির জন্য চাপ দিতে থাকে ওই দালাল। কিন্তু ওই বাংলাদেশি তাতে অসম্মতি জানানোয় একসময় তাদের জেলে পাঠানোরও হুমকি দেয়। যদিও ইতিমধ্যেই গোটা বিষয়টি জানতে পারে পুণের ফরাসখানা থানার পুলিশ ওই দম্পতিকে উদ্ধার করে ও পরে আটক করে। ভারতীয় আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইন ও ১৪ ফরেনার্স আইনে মামলা হয়। আদালতের নির্দেশে দুই বছরের বেশি সময় কারাগারের মেয়াদও ভোগ করতে হয় ওই দম্পতিকে। কিন্তু নিজেদের দেশে ফেরার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি না হওয়ার কারণে থানা চত্বরেই একটি ঘরে তাদের থাকার ব্যবস্থা করে থানা কর্তৃপক্ষ। এতদিন ধরে সেখানেই অবস্থান করেছেন ওই বাংলাদেশি দম্পতি।
মাজিদা মন্ডল জানান ‘কোম্পানিতে কাজ পাওয়ার আশায় দেশের বাসায় দুই ছেলেকে রেখে ভারতে চলে আসি। কিন্তু পুণেতে আসার পরই দালাল আমাকে বুধওয়ার পেথ নামক যৌনপল্লীতে পতিতাবৃত্তি পেশায় যোগ দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। কিন্তু আমি যখন তার প্রতিবাদ করি, কাজ করতে অসম্মতি জানাই তখন আমার স্বামীকে গ্রেফতার করিয়ে দেয়। কারণ আমাদের কারো কাছেই বৈধ পাসপোর্ট বা ভিসা ছিল না। যাইহোক আমি কোনভাবে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে থানায় পৌঁছই এবং গোটা বিষয়টি জানাই। তখন অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের অভিযোগ আমাকেও গ্রেফতার করা হয়।’
মাজিদা আরও জানায় ‘দালাল আমাদের কোম্পানিতে কাজ দেওয়ার কথা বলে ভারতে নিয়ে আসে। কিন্তু আমরা যদি আগে বিষয়টি জানতাম আমাদের এই সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে, তবে পাসপোর্ট বা ভিসা ছাড়া কিছুতেই ভারতে আসতাম না। যে দালাল আমাদের এখানে নিয়ে আসে, সেই আমাদেরকে গ্রেফতার করিয়ে দিল। কিন্তু দুই বছর কারাগারের মেয়াদ কাটানোর পর আমরা এখন দেশে ফিরতে চাই। দেশের বাড়িতে আমার দুই সন্তান খুবই সমস্যায় আছে। আমরা এখন চাইছি শিগগিরি আমাদের দেশে ফেরত পাঠানো হোক।’
মাজিদার স্বামী মহম্মদ মন্ডলের অভিমত, দালালের হাত ধরে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তারা বাংলাদেশ থেকে পুনের বুধওয়ার পেট এলাকায় এসে পৌঁছয়। এরপর সেখানেই একটি ঘরে তাদের আটকে রাখা হয়। কিন্তু ওই দালাল চেয়েছিল তার স্ত্রীকে পতিতাবৃত্তি পেশায় নামানো কিন্তু তাতে সফল না হওয়ার কারণেই দালাল জেলের হুমকি দেয়। কিন্তু যেভাবেই হোক পুণের পুলিশ গোটা বিষয়টি জানতে পেরে তাদের আটক করে।
এরপর আদালতের নির্দেশে প্রায় দুই বছর তিন মাস তাদের পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে (সংশোধনাগার) কাটাতে হয় ওই দম্পতিকে। গত জুন মাসে কারাগারে সাজার মেয়াদ শেষে আদালতের নির্দেশে তাদের পুণের ফরসখানা থানায় নিয়ে আসা হয়। এরপর থেকে গত দুই মাস ধরে ওই থানাই হয়ে উঠেছে ওই বাংলাদেশি দম্পতির আশ্রয়স্থল। আর কার্যত সেই সময় থেকেই থানা কর্তৃপক্ষের তরফে নিয়মিত বাংলাদেশ হাই কমিশনের কাছে আর্জি জানিয়ে আসছে ওই বাংলাদেশি দম্পতিকে নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যপারে উদ্যোগ নিতে। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে তাদের নথি তৈরি না হওয়ায় ওই দম্পতির দেশে ফেরত যেতে সমস্যা তৈরি হয়।
তবে সবথেকে উল্লেখ্যযোগ্য ব্যাপার হল, ফরাসখানা থানার ইন্সপেক্টর রাজেন্দ্র ল্যান্ডেজ জানান, আদালতের নির্দেশ মেনেই আমরা তাদের আমাদের থানা চত্বরে থাকার অনুমতি দিয়েছি এবং তাদের চা-নাস্তা-খাবার সহ দৈনন্দিন যাবতীয় বন্দোবস্তও আমরাই করছি।’
তিনি আরও জানান, থানার ভিতরেই নিজেদের ঘরে ওই বাংলাদেশি দম্পতি ধর্মীয় রীতিনিতি পালন ও নিয়মিত নামাজও পরেছেন। দেশে দুই সন্তানের সাথে ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা বলারও ব্যবস্থা করেছে থানা কর্তৃপক্ষ। এমনকি গত মাসে বকরি ইদে ওই দম্পতিকে নতুন পোশাক কিনে দেওয়া হয় ফরসখানা থানার তরফে। থানার পুলিশ কর্মীদের সাথেই ঈদও পালন করেন ওই দম্পতি।
তবে সাজা শেষে দেশে ফেরার কাগজ তৈরী করতে সময় লেগে যায় প্রায় ৮০ দিন। অবশেষে দীর্ঘ ৮০ দিন পর পুনের ফরাসখানা থানা কাগজপত্র তৈরী শেষে বিশেষ পুলিশী পাহারায় রবিবার সন্ধ্যায় মুম্বাই থেকে কোলকাতার উদ্দেশে ট্রেনে রওনা দেয়।
তবে আড়াই বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত ওই দালালের সন্ধান পায় নি পুলিশ।