পল্লব হাজরা, খড়দহ: সালটা আনুমানিক ১৫৭০ থেকে ৭৫ এর মধ্যে। গৌড়ের নবাব তখন সোলেমান খাঁ। বলা হয়, শ্রীচৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দ প্রভু অপ্রকট হওয়ার পর নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্র দৈবাদেশ পান, মালদহের নবাবের রাজপ্রাসাদের তোরণে রয়েছে একটি কালো পাথর। সেই পাথর থেকে কৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরি করিয়ে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেইমত বীরভদ্র সপার্ষদ নামসঙ্কীর্তন করতে করতে হাজির হলেন গৌড়ে (এখনকার মালদহে)। জানা যায়, সেখানে অনেক অলৌকিক দৈব মহিমা ঘটে ( যার বর্ণনা এখানে দেওয়া হল না)। এরপর, শর্তানুযায়ী নবাব সোলেমানের রাজপ্রাসাদের তোরণে থাকা কষ্টিপাথরের এক খণ্ড আসে খড়দহে।এরপর বীরভদ্র দৈবাদেশে পাওয়া কৃষ্ণ বিগ্রহের বিবরণ দিয়ে মূর্তি গড়তে বলেন ভাস্করকে। ওই কষ্টিপাথর থেকে তিনটি কৃষ্ণ বিগ্রহ তৈরি হয়। এই তিন বিগ্রহের মধ্যে বীরভদ্র দৈবাদেশ পাওয়া সত্য, শিব ও সুন্দরের প্রকাশ দেখতে পান শ্যামসুন্দর বিগ্রহে। অন্য দুই বিগ্রহের একটি পাঠানো হয় আকনায় রুদ্র পণ্ডিতের কাছে। পণ্ডিত বিগ্রহকে বল্লভ জীউ নামে প্রতিষ্ঠা করেন। দেবতার নামে আকনার নতুন নাম হয় বল্লভপুর। বীরভদ্র তৃতীয় বিগ্রহের নাম রাখেন ‘নন্দদুলাল’। নন্দদুলালকে বীরভদ্র পাঠান স্বামীবনে (সাঁইবোনা) লক্ষণ পণ্ডিতের কাছে।
প্রভু নিত্যানন্দের চতুর্দশ বংশধর সরোজেন্দ্র মোহন গোস্বামী জানান, আনুমানিক ১৫৭৫ সালে এক মাঘী পূর্ণিমায় বীরভদ্র গোস্বামী কষ্টিপাথর দিয়ে গড়া “শ্যামসুন্দর” কে খড়দহের কুঞ্জবাটীতে প্রতিষ্ঠা করেন,যার অভিষেক করেন অদ্বৈতাচার্যের জ্যেষ্ঠ পুত্র অচ্যুতানন্দ। পরে নিত্যানন্দের সহধর্মিণী জাহ্নবা দেবীর ইচ্ছেয় শ্রীশ্যামসুন্দরের বামে অষ্টধাতুর রাধিকা মূর্তিও প্রতিষ্ঠিত হয়।
সরোজেন্দ্র বাবু আরও জানান, শ্রীপাট খড়দহের খ্যাতি কিন্তু প্রধানত শ্রীশ্রীরাধা-শ্যামসুন্দর জীউয়ের মন্দিরের জন্যই। সেইসময় খড়দহের এই ঐতিহাসিক রাধা-শ্যামসুন্দর বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই ঘটেছিল এক ধর্মবিপ্লব।শুধু ধর্মীয় বিভেদই নয়, শ্রীশ্যামসুন্দর মন্দির মুছে দিয়েছে হিন্দু ধর্মের অভ্যন্তরীণ বিভেদরেখাও।
এই মন্দির বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত ধর্মের মিলনক্ষেত্র। এখানে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে পূজিত হন চতুর্দশ চক্রের অনন্তদেব, দশমহাবিদ্যার তৃতীয় মহাবিদ্যা ত্রিপুরাসুন্দরী এবং নীলকণ্ঠ শিব। নিত্যানন্দ কুঞ্জবাটীতে দুর্গাপুজোরও প্রচলন করেছিলেন। আবার শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকাকে কলঙ্ক থেকে বাঁচাতে বৃন্দাবনে কালী রূপ ধারণ করেছিলেন বলে দীপান্বিতা অমাবস্যায় শ্যামকে ‘শ্যামা’রূপে আরাধনা করা হয় এমনকি তিথি মেনে অন্নকূট উৎসবও করা হয় , যা আজও নিষ্ঠার সাথে হয়ে চলেছে।
আজ শুক্রবার সেই ঐতিহ্য মেনেই অন্নকূট উৎসব পালিত হল খড়দহ শ্যামসুন্দর মন্দির সহ মেজো বাড়ি গোপীনাথ মন্দিরে।।প্রভু নিত্যানন্দের চতুর্দশ বংশধর তথা মেজো বাড়ির অন্যতম সদস্য সরোজেন্দ্র মোহন গোস্বামী জানান, পাহাড়ের ন্যায় অন্ন সাজিয়ে পাঁচ রকম ভাজা সহ বিভিন্ন পদ অর্পণ করা হয় দেবতার কাছে। তবে করোনা আবহে সীমিত ভাবে এবছর পুজোর আয়োজন করা হয়েছে।
অপর দিকে ঐতিহ্যবাহী খড়দহ শ্যামসুন্দর মন্দিরেও দিনটি সাড়ম্বরে পালিত হয়। মন্দিরের অন্যতম সদস্য দেবমাল্য গোস্বামী জানান, আজ বিশেষ দিনে শ্যামের কাছে অন্ন, ডাল, সুক্ত, মুগঘন্ট, চচ্চড়ি, ডাল, পোস্ত, কুমড়োর ছক্কা, চাটনি , পায়েস, মালপোয়া সাজিয়ে দেওয়া হয় ভোগ হিসাবে। প্রতি বছর মন্দিরে বসিয়ে ভক্তদের ভোগ বিতরণ করা হলেও এই বছর বসে ভোগ খাওয়ার সুযোগ থাকছে না ভক্তদের। করোনা বিধি মেনে এবছর ভক্তের হাতে প্যাকেটে ভোগ তুলে দেওয়া হয়।। তবে অন্যান্য বছর ভক্তদের ভিড় দেখা গেলেও এই বছর করোনা আবহে তা ছিল অনেকটাই কম।