প্রায় ৮০০ বছরের প্রাচীন পালি ভাষায় মহিষের রক্ত দিয়ে লেখা তালপাতার পুঁথিতে লেখা হয়েছিল চণ্ডী মন্ত্র ৷ আর সেই মন্ত্রেই বাড়ির দুর্গার আবাহনে ব্রতী চট্টোপাধ্যায় পরিবার ৷ পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে আজও ৩০০ বছরের প্রাচীন বাবুবাড়ির দুর্গোৎসব (Banedi Barir Puja) রীতি-রেওয়াজ মেনেই সম্পন্ন হয় ৷
মহিষের রক্ত মেশানো কালি দিয়ে তালপাতার পুঁথিতে লেখা পালি ভাষার চণ্ডী মন্ত্র ৷ পশ্চিম বর্ধমান জেলায় দুর্গাপুরের সম্ভবত একমাত্র প্রাচীন জনপদ ‘আমরাই গ্রাম’-এ জমিদার বাড়ির দুর্গোৎসবে (Banedi Barir Puja)সেই চণ্ডী মন্ত্র পাঠ করে সপ্তসতী যজ্ঞানুষ্ঠান হয়। একদা শাল, পিয়াল, বট, অশ্বত্থের জঙ্গলে ঘেরা দুর্গাপুরের প্রাচীন জনপদ আমরাই গ্রামের বাবুদের প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন দুর্গাপুজোর সঙ্গে মিশে আছে বহু ইতিহাস ৷
কিভাবে শুরু হল বাবুবাড়ির দুর্গাপুজো: কয়েকশো বছর আগে দুর্গাপুরের আমরাই গ্রামের চট্টোপাধ্যায় পরিবার জমিদারিত্ব পেয়েছিলেন। প্রায় ৩০০ বছর আগে এই গ্রামেই শুরু হয়েছিল বাবুদের দুর্গাপুজো (Banedi Barir Puja)। শোনা যায়, একসময় শাক্ত মতে মহিষ বলি দিয়ে মা দুর্গার আরাধনা হতো এখানে। তবে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে পুজোর আচার-নিয়মেও। বহুকাল আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে মহিষ বলির প্রথা। বাবুবাড়ির দুর্গা বৈষ্ণব মতে পূজিতা হন। দামোদর দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে। বড় হতে হতে আজ এক বিরাট মহীরুহে পরিণত হয়েছে আমরাই গ্রামের চট্টোপাধ্যায় পরিবার। তবে জমিদার বাড়ির প্রাচীন রীতি রেওয়াজ সব বজায় রেখেই নিষ্ঠার সাথে পুজোর আয়োজন হয় আজও।
পুজোর নিয়মে উলট পুরণ: এখানে মা দুর্গার বাঁদিকে অর্থাৎ পুরোহিতের ডানদিকে থাকেন সিদ্ধিদাতা গণেশ। কারণ, একবার পুরোহিত প্রশান্ত ভট্টাচার্য মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন ‘দক্ষিণে গণেশায় নমঃ’। সেই থেকে গণেশের মূর্তি পুরোহিতের ডান দিকেই থাকে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা পুজোয় (Banedi Barir Puja)।
সপ্তসতী মহাযজ্ঞের রীতি: বাবুবাড়ির পুজোয় সবচেয়ে বড় রীতি সন্ধিপুজোর সময় ‘সপ্তসতী মহাযজ্ঞ’-এর আয়োজন। পশ্চিম বর্ধমান জেলায় সম্ভবত আর কোনও বনেদি বাড়ির দুর্গাদালানে এই মহাযজ্ঞের আয়োজন হয় না বলেই দাবি চট্টোপাধ্যায় পরিবারের। এক আসনে উপবিষ্ট হয়ে ভট্টাচার্য মহাশয় অখণ্ড চণ্ডী মন্ত্র পাঠ করেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বেল কাঠ, শুদ্ধ ঘৃত-সহযোগে এই মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী, পুরোহিত যখন চণ্ডী মন্ত্র পাঠ করেন ঠিক সেই সময় বাবুবাড়ির এক প্রতিনিধি চণ্ডী মন্ত্র সঠিক পাঠ হচ্ছে কি না, তা নিরীক্ষণ করেন। শুধু তাই নয়, প্রায় ৮০০ বছর আগের তালপাতার পুঁথিতে মহিষের রক্ত সহযোগে তৈরি করা কালি দিয়ে লেখা পালি ও সংস্কৃত ভাষার সহযোগে চণ্ডীর উপাসনা সম্বলিত পুঁথি পাঠ করেই এই পুজোর (Banedi Barir Puja) আয়োজন হয় মহাসপ্তমী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত।
পুজোর এই কয়েকটা দিন এই জমিদার বাড়ির সদস্যরা দেশ-রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে একত্রিত হন ‘আমরাই গ্রাম’-এর দালানে। কালের প্রবাহে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও জমিদার বাড়ির এই পুজোর প্রাচীন রীতি-রেওয়াজ আজও অটুট রয়েছে। তবে একসময় মন্দির ঘেঁষে তৈরি হয়েছিল ভোগ মন্দির, নাট মন্দির, নাট মঞ্চ। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ তা-আর নেই ।