বেলঘরিয়ায় সম্প্রতি ঘটে যাওয়া গুলি কাণ্ডে (Belgharia Shooting Case) নতুন তত্ত্ব উঠে এসেছে, যা এলাকায় চলমান রাজনৈতিক এবং শিল্প সম্পর্কিত বিবাদকে কেন্দ্র করে আরও একটি জটিলতা তৈরি করেছে। ৮ মার্চ, বেলঘরিয়ার উত্তর বাসুদেবপুর এলাকায় একটি চায়ের দোকানে গুলি চলে, যেখানে গুলিবিদ্ধ হন তৃণমূল শ্রমিক নেতা বিকাশ সিং। যদিও প্রথমে প্রণয়ঘটিত কারণে এই ঘটনা ঘটে বলে দাবি করা হয়েছিল, তবে এখন বিজেপি নেতা অর্জুন সিংয়ের অভিযোগ, টেক্সম্যাকো কোম্পানির বখরার লড়াই এবং ঠিকাদারি পাওয়ার যুদ্ধে জড়িত থাকায় এই গুলি চালানো হয়েছে।
টেক্সম্যাকোর বড় বরাত এবং তার প্রভাব
টেক্সম্যাকো, একটি বিশাল শিল্প প্রতিষ্ঠান, যা সম্প্রতি ভারতের রেলওয়ের কাছ থেকে ৬,৪৫০ কোটি টাকার একটি বিশাল বরাত পেয়েছে। এই বরাতে ৩৯ মাসে ২০,০০০ ওয়াগন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি টেক্সম্যাকোর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বরাত, এবং কোম্পানির শ্রমিকদের জন্যও এটি বড় একটি সুযোগ। তবে, এই বিশাল বরাতকে ঘিরে শাসক দলের এবং বিরোধী দলের মধ্যে যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন চলছে, তার প্রভাব পুরো এলাকায় পড়ছে।
২০২২ সালে রেলওয়ের বরাত পাওয়ার পর, টেক্সম্যাকো শ্রমিকদের মধ্যে বেশ কিছু সুবিধা এসেছে, কিন্তু একই সময়ে এই বরাতটি ঘিরে নানা গন্ডগোলও শুরু হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, টেক্সম্যাকোতে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাত পাওয়ার পর থেকে নানা ধরনের অশান্তি এবং ‘তোলা তোলা’ (টাকা সংগ্রহের) সমস্যা দেখা দিয়েছে। বিজেপি নেতা অর্জুন সিং এই গুলি কাণ্ডের পিছনে টেক্সম্যাকোর নিয়ন্ত্রণে অর্থনৈতিক লড়াইয়ের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। তিনি দাবি করেছেন, টেক্সম্যাকোতে টাকা আদায় এবং তোলার জন্যই এই গুলি চালানো হয়েছে।
তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য
এদিকে, তৃণমূলের নেতারা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন, যদিও তারা টেক্সম্যাকোতে চলমান অশান্তির বিষয়টি অস্বীকার করেননি। কামারহাটি পুরসভার কাউন্সিলর নির্মলা রাই অভিযোগ করেছেন, “এলাকার বাইরে থেকে কিছু লোক এসে ঝামেলা সৃষ্টি করছে।” সেই সঙ্গে কামারহাটির বিধায়ক মদন মিত্রও জানান, “টেক্সম্যাকোতে নানা ধরনের অশান্তি চলছে। মারামারি, পুলিশকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, এবং টেক্সম্যাকো অফিসারদের চমকানো হচ্ছে।”
এমনকি, মদন মিত্র আরো বলেন, “টেক্সম্যাকোকে ঘিরে অনেক ধরনের নোংরামি চলছে, যা শিল্পের পরিবেশে সমস্যার সৃষ্টি করছে।” এমন পরিস্থিতিতে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বেলঘরিয়ার গুলি কাণ্ড কেবল একটি একক ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর সংঘর্ষের অংশ যা টেক্সম্যাকোর বড় বরাত এবং তার সঙ্গে জড়িত অর্থনৈতিক লড়াইকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি
৩ মার্চ, রাজ্যের স্টেট লেভেল সিনার্জি বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন, “শিল্পে কোনও বাধা বরদাস্ত করা হবে না।” তিনি শিল্পের পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করার জন্য ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে তারা অযথা সমস্যা তৈরি না করে। এরপরেই, বেলঘরিয়ার গুলি কাণ্ডটি ঘটে, যা মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারির পরও শিল্পে বাধা সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে।
বিরোধীদের অভিযোগ
বিরোধীরা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সরকারকে আক্রমণ করেছে। বিজেপি নেতা শঙ্কর ঘোষ প্রশ্ন তুলেছেন, “যদি শিল্পে বাধা না দেওয়া হয়, তবে কেন টেক্সম্যাকোতে এমন বিশাল বরাত আসার পরও সমস্যা দেখা যাচ্ছে?” তিনি আরও বলেন, “সিঙ্গুরে যেভাবে সরষের বীজ ছিটানো হয়েছিল, বাংলার মানুষ এখন শিল্পে সরষে দেখছে!” তাঁর বক্তব্য, শিল্পপতিরা রাজ্য থেকে পুঁজি সরিয়ে অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে, যা বাংলার অর্থনীতি এবং শিল্পে বড় ধরনের আঘাত।
এদিকে বেলঘরিয়ার গুলি কাণ্ড নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। টেক্সম্যাকো কোম্পানির বিশাল বরাত এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতি রাজ্যে শিল্পের অবস্থান এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক প্রশ্ন তুলে ধরেছে। একদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হুঁশিয়ারি, অন্যদিকে বিরোধীদের অভিযোগ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই ঘটনা শুধু শিল্প পরিবেশেরই নয়, বরং রাজ্যের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিবেশের উপরও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে।
এখন দেখার বিষয় হল, রাজ্য সরকার এবং পুলিশ প্রশাসন এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এবং শিল্পের পরিবেশে স্থিতিশীলতা আনার জন্য কি কার্যকর উদ্যোগ নেয়।