মদন মোহন সামন্ত: ইছাপুর আলেয়ার কর্ণধার, নির্দেশক ও সর্বক্ষণের নাট্যকর্মী শুভেন্দু মজুমদার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার অ্যাপোলো হাসপাতালে বেশ কয়েকদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সেই মৃত্যুর কাছে জীবন সঁপে জীবনমঞ্চ থেকে চিরবিদায় নিলেন একুশে ডিসেম্বর সকাল ১১ টা ২৫ মিনিটে।
অকস্মাৎ তাঁকে হারিয়ে শোকাহত সকলেই। সমগ্র বাংলা থিয়েটার জগতের পক্ষ থেকে শুভেন্দু দা’র বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি এবং যথাযোগ্য প্রণাম জানাই।
১৯৬৬ সালের ১৮ জানুয়ারি উত্তর ২৪ পরগণার ইছাপুরে জীবনমঞ্চে প্রবেশ করেন তিনি। ক্রমে হয়ে ওঠেন সর্বক্ষণের নাট্যকর্মী এবং ইছাপুর আলেয়া নাট্য সংস্থার নাট্যপ্রাণ। অভিনেতা, নির্দেশক, শুভেন্দু মজুমদারের বাবা সুধাংশু নারায়ণ মজুমদার। শুভেন্দু নিয়মিত নাট্যচৰ্চার ইচ্ছায় ইছাপুর আলেয়া নাট্য সংস্থায় যোগ দিয়েছিলেন।
সন্তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় ‘আততায়ী’ নাটকে অভিনয় করেছিলেন। নাট্যকার অসীম ত্রিবেদী ও নট নির্দেশক শপথ-এর শ্যামল ভট্টাচার্যরা তাঁকে উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়েছিলেন নিয়মিত থিয়েটার চৰ্চার জন্য।ইছাপুর আলেয়া নাট্য সংস্থায় শুভেন্দু মজুমদার অভিনীত অথবা নির্দেশিত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য — সংবিৎ, ক্যাপসুল, নেপথ্যে, সুচেতনার জন্য, এই তো উঠে এসো, এসো সকাল, কল্পলোকের গল্প, পাঁচিল, অপদেবতা, নৈকষ্যনিশুতে, গ্রন্থি, রুদ্ধ প্রবাহ, নন্দলাল, বহ্নিমান, বিকল্প, নতুন শ্রাবণ, e মানবিক, 6 : 1, স্পর্শ, অবরোধ, শূল, রামকানাইয়ের নিরবুদ্ধিতা, ছায়াযুদ্ধ, জলরঙে দুর্গা,তমসা সহসা, ইচ্ছেডানা, প্রদোষকাল, অবিচ্ছেদ্য, পাসওয়ার্ড, জাতক ইত্যাদি।
এগুলির মধ্যে শুধুমাত্র সংবিৎ নাটকটি ছাড়া প্রত্যেকটি নাট্য প্রযোজনারই নির্দেশক এবং মূল চরিত্রাভিনেতা ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম শুভেন্দু। ইছাপুর আলেয়া ছাড়াও শুভেন্দু অন্যান্য যে সমস্ত নাট্যদলের নাট্য প্রযোজনাগুলিতে অভিনয় করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য — ক্যালকাটা কোরাস প্রযোজিত, সঞ্জয় গুহঠাকুরতা নির্দেশিত ‘তিমিঙ্গিল’, ‘আন্তিগোনে’ ও ‘যুধিষ্ঠির’ নাটক। শপথ প্রযোজিত, শ্যামল ভট্টাচার্য নির্দেশিত ‘ভাঙন’ ও ‘রাজভূত’ । নটধা প্রযোজিত, শিব মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত ‘মহাভারত’। এছাড়াও শুভেন্দু অন্যান্য দলে অভিনয় করেছেন মহাবিদ্যা, ফাঁস, মধুরেণ, দমকল, সকালের জন্য, দিনান্তে, ইত্যাদি নাটকে।
সর্বক্ষণ নাটক, নাটক এবং নাটক নিয়েই বেঁচে থাকা শুভেন্দু মুহূর্তে অমানিশার চাঁদ হয়ে যাবে তা কল্পনাতীত। নিত্যদিনের চিন্তা ভাবনাগুলোকে বড্ড নাড়া দিয়ে যায় এমন সহসা অকালে চলে যাওয়া।
শ্যামনগর নাট্য বিতানের নাট্যকর্মী রাজীব তফাদার বলেন, ‘পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তখনও যেন শুভেন্দু দা আবারও থিয়েটারেই ফিরে আসেন, এই প্রার্থনা কায়মনোবাক্যে রইল ঈশ্বরের কাছে। ‘
তিনি আরও বলেন, শ্যামনগর নাট্যবিতানের প্রশিক্ষক ছিলেন নাট্যবিতানের জন্মলগ্ন থেকে। তাঁর লেখা দু’টি নাটক ‘ইনসানিয়াত’ ও ‘বহ্নিমান’। আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়, ২০১৯ সালে নাট্যবিতান তাঁকে নিয়ে “সৃজনে শুভেন্দু” নাট্যোৎসব আয়োজনের পাশাপাশি করে তাঁকে নিয়ে ‘নাট্য বিতান নাট্য কথা’ পত্রিকাও প্রকাশ করা হয়।’
জীবনমঞ্চ ত্যাগের পর ঐ রাতেই তাঁর নশ্বর দেহ প্রথমে তাঁর বাসভবনে, এরপরে তাঁর নাট্যদল ইছাপুর আলেয়াতে এবং শেষে শ্যামনগর রবীন্দ্রভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। শীতের রাত তখন জানান দিচ্ছিল ঘড়িতে সময় ১১.৩০। তখনও রবীন্দ্র ভবনে অগণিত মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসছেন তাঁদের প্রিয় নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশককে।