নয়াদিল্লী: দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের জন্য কেন্দ্র গত বছর ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্প চালু করে। গ্রামাঞ্চলে সকলের বাড়িতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ জল সরবরাহ করাই এর উদ্দেশ্য। রাজ্যগুলির সঙ্গে সহযোগিতামূলক যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর আওতায় এই ফ্ল্যাগশিপ কর্মসূচিটি চালু করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করা ছাড়াও মহিলাদের, বিশেষ করে ছোট ছোট মেয়েদের দূর্দশা লাঘব করাই এই উদ্দেশ্য । এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্যই হল গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি পরিবারে পাইপবাহিত জল পানের বিষয়টি সুনিশ্চিত করা। সাম্য এবং সমন্বয়ের উপর ভিত্তি করে জল জীবন মিশনের প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত করা হয়। আগে এই প্রকল্পে পরিকাঠামো তৈরির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হলেও বর্তমানে বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছে দেওয়ার ওপরেই জোর দেওয়া হচ্ছে।
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অ্যানুয়াল অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে দেখা গেছে সমস্ত রাজ্য তাদের জল জীবন মিশনের জন্য অ্যানুয়াল অ্যাকশন প্ল্যান জমা দিলেও পশ্চিমবঙ্গ এখনও জলশক্তি মিশনের জাতীয় কমিটির কাছে কোন কর্মপরিকল্পনা জমা দেয়নি।পশ্চিমবঙ্গে ৪১,৩৫৭টি গ্রামে ১ কোটি ৬৩ লক্ষ বাড়ি রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মাত্র ২ লক্ষ বাড়িতে পাইপ বাহিত জল পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। ২০১৯-২০তে পরিকল্পনা করা হয়েছিল রাজ্যে ৩২ লক্ষ ২৪ হাজার বাড়িতে পাইপ বাহিত জল পৌঁছে দেওয়া হবে। কিন্তু মাত্র ৪,৭২০ বাড়িতে জলের সংযোগ পৌঁছে দেওয়া গেছে। ২০২০-২১ সালে ৬৪ লক্ষ ৪৩ হাজার বাড়িতে জলের সংযোগ দেবার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এরমধ্যে গত বছরের বকেয়া ৩২ লক্ষ ১৯ হাজার বাড়ির হিসেবও রয়েছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য তাই যথাযথ কৌশল নিতে হবে।
২০১৯-২০ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের জন্য ৯৯৩ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৪২১ কোটি ৬৩ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছে। বাকি অর্থ ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়াও আর্সেনিক এবং ফ্লুরাইড অধ্যুষিত এলাকায় জল সরবরাহের জন্য ১,৩০৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। যারমধ্যে ৫২৩ কোটি ৩৬ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়নি। তাই পয়লা এপ্রিল ২০২০-র হিসেব অনুযায়ী গ্রামাঞ্চলে বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহের জন্য পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় খাতে ১,১৪৬ কোটি ৫৮ লক্ষ টাকা রয়েছে। ২০২০-২১ সালে রাজ্যের জন্য ১,৬১০ কোটি ৭৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে এই খাতে পশ্চিমবঙ্গ ২,৭৫৭ কোটি ৩৪ লক্ষ টাকা পাবে। সব মিলিয়ে ২০২০-২১ সালে রাজ্যে সর্বত্র বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছে দেওয়ার জন্য জল জীবন মিশনের আওতায় ৫,৫১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়াও রাজ্যের জল প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনে অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করার সংস্থানও থাকছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ের জন্য প্রতি মাসের ভিত্তিতে প্রকল্প রূপায়ণের পরিকল্পনা করা উচিত।
জল জীবন মিশনের আওতায় রাজ্যগুলি যাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ করতে পারে, কেন্দ্র সেই বিষয়টি নিশ্চিত করছে। বর্তমান জল প্রকল্পগুলির ক্ষমতা বৃদ্ধির ওপরেও জোর দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ৪১,৩৫৭টি গ্রামের মধ্যে ২২,১৫৫টি গ্রামে অর্থাৎ ৫৪ শতাংশ গ্রামে নলের মাধ্যমে জল সরবরহের পরিকাঠামো রয়েছে। অথচ এইসব গ্রামে মাত্র ২ লক্ষ বাড়িতে জলের সংযোগ রয়েছে। গ্রামে যাদের বাড়িতে জলের সংযোগ নেই তাদের অধিকাংশই দরিদ্র এবং প্রান্তিক মানুষ। আগামী ৪-৬ মাসের মধ্যে এই কাজে গতি আনতে রাজ্যের সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন। যেসব গ্রাম উচ্চাকাঙ্খী জেলার অন্তর্ভুক্ত, তপশীলি জাতি ও উপজাতি অধ্যুষিত গ্রাম এবং সংসদ আদর্শ গ্রাম যোজনার আওতায় থাকা গ্রামগুলিতে এই প্রকল্পের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
জল জীবন মিশনের মাধ্যমে ২,৪১৪টি আর্সেনিক এবং ফ্লুরাইড প্রভাবিত গ্রামে সকলের বাড়িতে যাতে ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে পাইপের মাধ্যমে জল পৌঁছে দেওয়া যায়, জাতীয় গ্রীণ ট্রাইবুনালের এই অন্তর্বর্তী নির্দেশটি পালন করার ওপর এখন সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যদি এই সময়ের মধ্যে ওইসব এলাকার বাড়িতে জলের সংযোগ দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে এলাকাভিত্তিক জল পরিশোধন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে౼যার মাধ্যমে ৮-১০ এলপিসিডি (লিটারস পার ক্যাপিটা পার ডে) জল সরবরাহ করতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গ, পঞ্চদশ অর্থ কমিশনে ৪,৪১২ কোটি টাকা পাবে যার অর্ধেক অর্থে জল সরবহার ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা করতে হবে। এমজিএনআরইজেএস, জল জীবন মিশন, এসবিএম (জি) – এই প্রকল্পগুলির মাধ্যমে পঞ্চদশ অর্থ কমিশন থেকে পাওয়া অর্থ জল সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। জেলা খনিজ উন্নয়ন তহবিল, ক্যাম্পা, কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল এবং ভিলেজ অ্যাকশন প্ল্যানের সাহায্যে জল সংরক্ষণ করে পানীয় জলের সংকট মেটাতে জলের উৎসগুলিকে শক্তিশালী করা যেতে পারে।
সার্বিকভাবে বলা যায় জল জীবন মিশনকে গণ আন্দোলনে পরিণত করতে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে হবে। গ্রামের মধ্যে জল সরবরাহের পরিকাঠামো তৈরি করে সেটি পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও স্বেচ্ছাসেবক সংগঠনগুলির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। গ্রামের যে সব বাসিন্দা রাজমিস্ত্রি, কলের মিস্ত্রি এবং বিদ্যুতের মিস্ত্রি౼ তাঁদের দক্ষতাকেও এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারীর প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে জল সরবরাহ এবং জল সংরক্ষণ প্রকল্পের কাজ দ্রুত বাস্তবায়িত করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে লোকের বাড়িতে জল পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি যেসব দক্ষ এবং আধা-দক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে এসেছেন তাঁদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব হবে। যারফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে জোয়ার আসবে।
তথ্য সুত্র- প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো।