সঞ্জয় কাপড়ি,পূর্ব মেদিনীপুর: “কাটা মাছ” বা পূর্ব মেদিনীপুরের চলতি কথায় “বিলাসপুরের মাছ”-এর ঠেলায় দেশীয় জলজ মাছেদের ব্যবহার কমতে কমতে বাড়ির ছোটদের কাছে তা অচেনা থেকে যাওয়ার জোগাড় হতে চলেছে। সৌজন্যে হাটের পরিবর্তে বাজার, খানিকটা অর্থনৈতিক ও তথাকথিত উন্নয়ন।
নবীন প্রজন্মের শিশু কিশোরদের ঠাকুরদা , বাবা-জ্যাঠা-কাকারা নিজেদের জমিতে ফসল ফলাতেন, উঠোনে বা বাগানে বা “বাড়ি”তে অথবা খড় কিংবা টালির চালে নানা রকম সবজি ফলাতেন। নিজেদের পুকুরে মাছ চাষ করতেন। পাশাপাশি হাঁস মুরগী পালন করে ডিম ও মাংসের প্রয়োজন মেটাতেন। গরু, বলদ পুষে দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং চাষের প্রয়োজনীয়তা মেটাতেন খাঁটি খাবার খেয়ে শরীর গড়ে।
শরীর গঠনে আমিষের মূল উৎস ছিল মূলত, নিজেদের পুকুরের হরেক রকম মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া। পোনা মাছ অর্থাৎ রুই, কাৎলা, মৃগেল একই পুকুরে এক সঙ্গে চাষ করা যায়, যেতও। তবে সে সব খাওয়ার জন্য জাল ফেলে ধরা হ’ত বহুদিন পরপর। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে কুচো মাছের বিকল্প ছিল না। যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনই পুষ্টিকর ও সুস্বাদু ছিল সে সব!
বিনা খরচে দারুণ পুষ্টি। কী না থাকত! মৌরলা, পুঁটি, চাঁদা, দেঁড়ে, নারকেলি, বেলে বা ভ্যাদা, ন্যাদস বা লেদুস, বাটা, ট্যাংরা, ফলুই, ভেটকি, চ্যামা, গলদা চিংড়ি, বাগদা চিংড়ি, নোনা চিংড়ি, পুকুরে চিংড়ি, কালো চিংড়ি, ঘুষি চিংড়ি, ইত্যাদি যাদের একসঙ্গে স্থানীয় কথায় বলা হ’ত “চাঁদা-চিঙুড়”! এছাড়া জিয়ল মাছ, শোল, চ্যাঙ ল্যাটা, মহাশোল, কই, শিঙি, মাগুরের পাশাপাশি ছিল তোলা কাঁকড়া, চিতি কাঁকড়ারাও।
যত্ন ও পরিচর্যার অভাবে এদের অধিকাংশ আজ অমিল। চালানী কাটা মাছেই বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে নতুন প্রজন্ম মাছ চেনা ভুলতে বসেছে। হাট নয়, দৈনন্দিন বাজার থেকে বাবা আনেন “কাটা মাছ” বা “কাটা পোনা”। পোনা মাছ মানে রুই, কাতলা, মৃগেল মাছের কাটা অংশবিশেষ । বাড়িতে আনলে যা বাচ্চাদের কাছে “কাটা মাছ “ হিসেবে পরিচয় পায়। ইদানীং অবশ্য আর এক বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে।
দেশীয় এই মাছগুলির পরিবর্তে বাড়িতে আনতে হচ্ছে আমেরিকান রুই বা সাইপ্রিনাস বা সাইপ্রাস, আফ্রিকান তিলাপিয়া, নাইলোটিকা, রূপচাঁদা বা পিরানহা, চিনা সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প ইত্যাদি। ফলে দায় হয়ে উঠেছে আমাদের দেশজ রুই, কাৎলা, মৃগেল, মাগুর, শিঙি, কৈ, গলদা, বাগদা চেনা। আর এইখানেই প্রয়োজন অনুভূত হয়েছে মাছ চেনানোর তাগিদের।
সেই তাগিদ থেকেই “মাছ চেনার পাঠশালা” শীর্ষক এক কর্মশালা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়ার পরানচক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ক্ষুদে কচিকাঁচাদের মাছ চেনাতে সেখানে হাজির ছিলেন হলদিয়ার মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ আধিকারিক সুমন কুমার সাহু। বিদ্যালয়ের বাচ্চা বাচ্চা পড়ুয়ারা নানা রকম মাছেদের বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলি মজাদার গল্পের ছলে শুনল। সাথে ছবিতে মাছগুলিকে দেখল। অনেকেই এসব দেখে বেজায় খুশি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুকুমার শেঠ জানালেন, সুমনবাবুর এই কর্মশালা ও করোনা পরবর্তী সময়ে পঠনপাঠন চালু হওয়ার পর এমন প্রয়োজনীয় বিষয়ে ব্যবহারিক আলোচনার মাধ্যমে পড়ুয়াদের পাশাপাশি লিক্ষাদাতারাও উপকৃত হলেন। মৎস্য আধিকারিক সুমন কুমার সাহু জানালেন, এরকম কর্মসূচির ফলে বর্তমান নবীন প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাওয়া মাছ রক্ষার সাথে সাথে প্রকৃতির প্রতি ভালবাসার বার্তা দেওয়া হচ্ছে। তিনি চান, প্রতিটি বিদ্যালয়ে এমন “মাছ চেনার পাঠশালা” আয়োজন করলে আরও বেশি পড়ুয়াদের মধ্যে উৎসাহ ও সচেতনতা আনা যাবে।