Illegal Immigration:”সীমান্তের ওপারে নীরব পরিবর্তন,পশ্চিমবঙ্গের জনবিন্যাসে প্রভাব”

 নীরব রূপান্তর

১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের গাঙ্গেয় বদ্বীপে একটি নীরব জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঘটছে, যা এই ঐতিহাসিক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভিত্তি বদলে দিচ্ছে। ১৯৫১ সালে, রাজ্যের জনসংখ্যার ৭৮.৪৫% হিন্দু এবং ১৯.৮৫% মুসলিম ছিল। কিন্তু ২০১১ সালের মধ্যে এই অনুপাত পরিবর্তিত হয়ে যথাক্রমে ৭০.৫৪% এবং ২৭.০১% হয়েছে। উচ্চ জন্মহার এবং লাগাতার অবৈধ অভিবাসনের (illegal immigration) কারণে ২০২৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৩০-৩৫% এ পৌঁছতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। সীমান্ত সংলগ্ন মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং উত্তর ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলোতে এই পরিবর্তন সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট, যা ভূ-রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংঘাতের জন্ম দিয়েছে।

হিলি বর্ডার।

 

ছিদ্রযুক্ত সীমানা ও নীরব দখল

বাংলাদেশ সংলগ্ন ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীরের চেয়ে একটি চালনী হিসেবেই বেশি কাজ করে আসছে। নদীমাতৃক এবং অরক্ষিত এই সীমান্তের বেশিরভাগ অংশই অবৈধ পারাপারের জন্য আদর্শ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই এই অনুপ্রবেশ শুরু হয়, তবে ১৯৫০-এর দশকে অর্থনৈতিক দুর্দশা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার কারণে এটি গতি পায়।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় লক্ষ লক্ষ শরণার্থী প্রবেশ করে, যার মধ্যে মুসলিম অভিবাসীরা প্রায়শই পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামগুলোতে মিশে যেত। পরবর্তীকালে, পাচারকারীদের একটি সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে, যারা দরিদ্র অভিবাসীদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৭,০০০-১০,০০০ টাকা এবং অপরাধীদের কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা পর্যন্ত নিত। গোয়েন্দা ব্যুরোর কর্মকর্তারা এটিকে একটি ‘সুপরিকল্পিত যন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখানে বাংলাদেশের এজেন্টরা সীমান্তের দুর্বল স্থানগুলো খুঁজে বের করতে স্থানীয় সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ রাখত।

বাস্তব ঘটনা এই নেটওয়ার্কের গভীরতা প্রমাণ করে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের অন্যতম দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আব্দুল মাজেদ প্রায় ২৩ বছর ধরে কলকাতায় ছদ্মবেশে বসবাস করেন এবং ভারতীয় পাসপোর্ট পর্যন্ত সংগ্রহ করেন। আরেক আসামি রিসালদার মোসলেহউদ্দিন বনগাঁয়ে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ওষুধ বিক্রেতা হিসেবে কাজ করেন। একজন অবসরপ্রাপ্ত বিএসএফ কর্মকর্তা সুনীল ভাটনগর বলেছেন, “বাংলাদেশিরা এলোমেলোভাবে প্রবেশ করে না। তাদের প্রবেশ উভয় পক্ষের পাচারকারীদের দ্বারা পরিচালিত হয়।”

2011 Census Data

১৯৭০-এর দশকে মূলত অর্থনৈতিক অভিবাসীরা প্রবেশ করলেও, ১৯৯০-এর দশক থেকে অপরাধী ও কট্টরপন্থীরাও এই স্রোতে যুক্ত হয়। ২০১৭ সাল থেকে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারাও এই তালিকায় যোগ দিয়েছে। কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট সরকারের আমল থেকেই এই অবৈধ অভিবাসনকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়েছে, যা স্থায়ী বসতি স্থাপনের পথ প্রশস্ত করে।

অনুপ্রবেশ ও অর্থনৈতিক আধিপত্য: বসতি স্থাপনকারী থেকে ব্যবসায়ী

একবার সীমান্ত পেরিয়ে গেলে অনুপ্রবেশকারীরা কেবল প্রান্তিক অবস্থানেই থাকেনি, বরং তারা অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করেছে। ভেড়ি বা মাছের খামার, রাস্তার পাশের দোকান এবং অন্যান্য ছোট ব্যবসায় তাদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো। এই উত্থান অনেক সময় স্থানীয় হিন্দুদেরকে তাদের ঐতিহ্যবাহী পেশা থেকে সরিয়ে দিয়েছে।

The Silent Invasion of Bengal

উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে, সাত-আট বছর আগে আসা রোহিঙ্গারা প্রথমে মাছের খামারে শ্রমিক হিসেবে কাজ করত, কিন্তু পরবর্তীতে শেখ শাহজাহানের মতো প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জন্য আইন প্রয়োগকারী হিসেবে কাজ শুরু করে। এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কৃষ্ণপদ মণ্ডল জানান, “রোহিঙ্গাদেরকে তৃণমূল নেতারা আশ্রয় ও চাকরি দিয়েছিলেন।”

এই অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ও ঘটেছে। কালীগঞ্জের মতো এককালের হিন্দু-প্রধান এলাকায় এখন মুসলিম জনসংখ্যা ৬১% এর বেশি, যার ফলে হিন্দু উৎসবগুলোতে শঙ্খধ্বনি কমে গেছে। বাদুড়িয়ার বাসিন্দা শক্তিপদ দাস, যিনি ১৯৭০-এর দশকে মুসলিমদের হয়রানির কারণে নিজের পৈতৃক ভিটা ছেড়ে চলে যান, তার ঘটনা এই মানবিক ক্ষতির এক বাস্তব চিত্র।

The Silent Invasion of Bengal Porous Borders and the Roots of Demographic Shift

একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসার সৌমিত্র প্রামাণিক কট্টরপন্থার লক্ষণ দেখতে পান। তিনি বলেন, মাদ্রাসাগুলো অসহিষ্ণুতা ছড়াচ্ছে এবং স্থানীয় মুসলিমরা রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় আরও আগ্রাসী হয়ে উঠছে। ২০১৯ সালে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) এর অভিযানে জালিয়াতি থেকে বছরে প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকার আয়ের তথ্য প্রকাশ পায়। এর মধ্যে ৩,০০০ কোটি টাকা জাল নথি তৈরি থেকে এবং ১,০০০ কোটি টাকা অনুপ্রবেশের ফি থেকে আসত।

এই প্রভাব শুধু বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, ওড়িশার সম্বলপুরের মতো জায়গায়ও এর প্রভাব পড়েছে, যেখানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মুসলিমরা এখন জনসংখ্যার ৯%।

People offer namaz on the occasion of Eid-ul-Fitr festival in Nadia West Bengal PTIনদীয়ায় ঈদ-উল-ফিতর উৎসব উপলক্ষে মানুষ নামাজ পড়ছে।

রাষ্ট্রের সহযোগিতা: জাল নথির মাধ্যমে পৃষ্ঠপোষকতা

অবৈধ অনুপ্রবেশের প্রক্রিয়াটি সরকারি কাঠামোর গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত। ধারাবাহিক সরকারগুলো শুধু এটিকে সহ্যই করেনি, বরং জাল পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে। সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে জাল আধার কার্ড, পাসপোর্ট, এবং অন্যান্য পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়, যা অভিবাসীদেরকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতে সাহায্য করে।

২০১৯ সালের নভেম্বরে ইডি-এর অভিযানে জালিয়াতির সরঞ্জাম, নগদ টাকা এবং অস্ত্র জব্দ করা হয়। ইডি কর্মকর্তারা একে “বৃহত্তর মানব পাচার চক্রের অংশ” হিসেবে বর্ণনা করেন, যার মাধ্যমে বছরে আনুমানিক ১,০০,০০০ অনুপ্রবেশকারী প্রবেশ করে। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে আটক পলাশ অধিকারী নামের এক ব্যক্তি নিজেকে বাংলাদেশের শেখ মঈনুদ্দিন হিসেবে স্বীকার করে। সে জানায় যে স্থানীয় তৃণমূল নেতারা তার জন্য জাল নথি তৈরি করে দিয়েছিলেন।

People offer namaz on the occasion of Eid-ul-Fitr festival in Nadia West Bengal PTIহাওড়া জেলার একটি মসজিদে ঈদ-উল-ফিতর উৎসব উপলক্ষে লোকজন নামাজ পড়ছেন।

সন্দেশখালিতে, রোহিঙ্গারা অনুগত পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে, যা তাদের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তোলে। বিজেপি নেতা সুকান্ত মজুমদার তৃণমূলকে তাদের ভোটব্যাংকের জন্য এই কাজ করার অভিযোগ করেন। অন্যদিকে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই তদন্তকে বাঙালি-বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেন।

The State s Complicity Patronage Through Fake Documents

ফিরহাদ হাকিমের একটি বিতর্কিত মন্তব্য যে মুসলমানরা বাংলায় “বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ” হতে পারে, তা রাজনৈতিক অন্তর্নিহিত স্রোতকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন যে এই অনুপ্রবেশকারীদেরকে রাষ্ট্রযন্ত্রই রক্ষা করে, এবং যেকোনো নজরদারিকে ‘সংখ্যালঘু-বিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই জটিল পরিস্থিতি কেবল সার্বভৌমত্বকেই ক্ষুণ্ণ করছে না, বরং রাজনৈতিক মেরুকরণকেও বাড়িয়ে তুলছে।