কৃষকদের কল্যাণ এবং ৮১ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টির সমতা নিশ্চিত (India food security) করার লক্ষ্যে ভারতের বহুমুখী অভিযানের… .
৮১ কোটি মানুষের হেঁশেল সুরক্ষিত! NFSM থেকে NFSA: খাদ্য সুরক্ষায় ভারতের ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, ২০২৯ সাল পর্যন্ত বিনামূল্যে রেশন
খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা: এক বহুমুখী অভিযান
১৫ই অক্টোবর, ২০২৫-এ প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি ভারতের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারের বহুমুখী এবং সুসংগঠিত প্রচেষ্টার উপর আলোকপাত করে। এই অভিযানের মূল লক্ষ্য হল: খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ৮১ কোটি মানুষের কাছে পুষ্টিকর খাদ্যের ন্যায়সঙ্গত বন্টন নিশ্চিত করা, যাতে সকলে সক্রিয় ও সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা কাঠামোর মূল ভিত্তি দুটি – জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি মিশন (NFSNM) এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন (NFSA), ২০১৩।
১. উৎপাদন বৃদ্ধি: জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি মিশন (NFSNM)
উদ্দেশ্য: কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা ও এলাকা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধান, গম, ডাল এবং অন্যান্য দানাশস্যের উৎপাদন বাড়ানো। মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং খামার স্তরের অর্থনীতিকে উন্নত করা।
বিবর্তন: ২০০৭-০৮ সালে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা মিশন (NFSM) হিসেবে শুরু হলেও, ২০২৪-২৫ সালে এটির নতুন নামকরণ করা হয় জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি মিশন (NFSNM), যেখানে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি পুষ্টির ওপরও জোর দেওয়া হয়।
কৃষক সহায়তা: এই মিশনের অধীনে কৃষকদের উন্নত জাতের বীজ উৎপাদন ও বিতরণ, শস্য সুরক্ষা প্রযুক্তি, শস্য বিন্যাস ভিত্তিক প্রদর্শন এবং ফসলের মরসুমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়।
২. বন্টন ও আইনি সুরক্ষা: জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন (NFSA) ও TPDS
আইনি অধিকার: জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন (NFSA), ২০১৩ গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭৫% এবং শহুরে জনসংখ্যার ৫০% মানুষকে, অর্থাৎ ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ৮১.৩৫ কোটি মানুষকে লক্ষ্যযুক্ত গণবন্টন ব্যবস্থার (TPDS) মাধ্যমে ভর্তুকিযুক্ত (বর্তমানে বিনামূল্যে) খাদ্যশস্য পাওয়ার আইনি অধিকার নিশ্চিত করে।
বিনামূল্যে খাদ্যশস্য: কেন্দ্রীয় সরকার ২০২৩ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে NFSA-এর অধীনে সুবিধাভোগীদের বিনামূল্যে খাদ্যশস্য প্রদান শুরু করেছে। এই সময়সীমা ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আরও পাঁচ বছরের জন্য (অর্থাৎ ২০২৯ সাল পর্যন্ত) বাড়ানো হয়েছে। এই খাতে আনুমানিক $১১.৮০ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হবে, যা সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে।
সুবিধাভোগী শ্রেণী
অন্ত্যোদয় অন্ন যোজনা (AAY) পরিবার: সবচেয়ে দরিদ্র পরিবার, যারা প্রতি মাসে প্রতি পরিবার পিছু ৩৫ কেজি খাদ্যশস্য পান। অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পরিবার (PHH): প্রতি মাসে প্রতি ব্যক্তি পিছু ৫ কেজি খাদ্যশস্য পান।
বিশেষ সুবিধা: এই আইনে গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদানকারী মা এবং ৬ মাস থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের পুষ্টিকর খাবার এবং গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদের ন্যূনতম ₹৬,০০০ টাকা নগদ মাতৃত্বকালীন সুবিধা পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। অক্টোবর ২০২৫ পর্যন্ত, ৭৮.৯০ কোটি সুবিধাভোগী বিনামূল্যে খাদ্যশস্য পাচ্ছেন।
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রধান সরকারি উদ্যোগ
প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনা (PMGKAY)
কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে সৃষ্ট আর্থিক চাপ কমাতে এই প্রকল্পটি চালু করা হয়েছিল।
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে PMGKAY-এর সুবিধা NFSA-এর সঙ্গে মিশে গেছে, যার ফলস্বরূপ সুবিধাভোগীরা পাঁচ বছরের জন্য (২০২৯ সাল পর্যন্ত) বিনামূল্যে খাদ্যশস্য পাবেন।
চালের পুষ্টি সংবর্ধন উদ্যোগ (Rice Fortification)
পুষ্টির অভাব দূর করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। যেহেতু ভারতের ৬৫% মানুষের প্রধান খাবার ভাত, তাই সরকার ২০২৪ সালের মধ্যে পর্যায়ক্রমে পুষ্টি সংবর্ধিত চাল সরবরাহ করার ঘোষণা করে।
প্রথম পর্যায়ে (২০২১-২২) ICDS ও PM-POSHAN প্রকল্পের মাধ্যমে শুরু হয়ে, তৃতীয় পর্যায়ে (২০২৩-২৪) তা লক্ষ্যযুক্ত গণবন্টন ব্যবস্থার বাকি জেলাগুলিকেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে সরবরাহ করা ১০০% চালেই পুষ্টি সংবর্ধন সম্পন্ন হয়েছে।
ব্যয়ভার: ২০২৮ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত পুষ্টি সংবর্ধিত চালের সার্বজনীন সরবরাহের জন্য ₹১৭,০৮২ কোটি খরচ ভারত সরকার বহন করবে।
সরাসরি সুবিধাভোগী স্থানান্তর (DBT) ও স্মার্ট-পিডিএস
নগদ স্থানান্তরের লক্ষ্য: খাদ্যশস্যের অপচয় ও দুর্নীতি হ্রাস করা, যোগ্য সুবিধাভোগীকে চিহ্নিত করা এবং মানুষকে তাদের খাদ্যের পছন্দ বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া। চণ্ডীগড় এবং পুদুচেরি সহ কিছু কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এই পদ্ধতি চালু আছে, যেখানে ভর্তুকির সমতুল্য নগদ অর্থ সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরিত হয়।
প্রযুক্তিগত সংস্কার: গণবন্টন ব্যবস্থাকে (PDS) আরও দক্ষ, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল করতে ডিজিটাইজেশান (১০০% ডিজিটাল রেশন কার্ড ও সুবিধাভোগী তথ্যভান্ডার), আধার সংযুক্তি (৯৯.৯%) এবং ই-পিওএস ডিভাইসের মাধ্যমে আধার যাচাই করে খাদ্যশস্য বিতরণ চালু হয়েছে।
SMART-PDS: ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রযুক্তির মাধ্যমে পিডিএস-এর আধুনিকায়ন ও সংস্কারের জন্য SMART-PDS চালু করা হবে।
মোবাইল অ্যাপ: স্বচ্ছতা ও সুবিধা বাড়াতে ‘মেরা রেশন ২.০’ (১ কোটির বেশি ডাউনলোড) এবং তৃণমূল স্তরের কর্মীদের সক্ষমতা বাড়াতে ‘অন্ন মিত্র’ মোবাইল অ্যাপ চালু করা হয়েছে।
‘এক দেশ, এক রেশন কার্ড’ (ONORC)
ভারতের সব ৩৬টি রাজ্য/কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে সফলভাবে চালু হয়েছে।
সুবিধা: প্রায় ৮১ কোটি সুবিধাভোগী দেশের যেকোনো ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের মাধ্যমে তাঁদের প্রাপ্য খাদ্যশস্য তুলতে পারেন। এটি পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ সহায়ক।
খাদ্যশস্য সংগ্রহ, মজুত ও বাজার স্থিতিশীলতা
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP): রাজ্য সরকারি সংস্থা এবং ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার (FCI) মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান ও গম MSP-তে কেনা হয়, যা কৃষকদের আয় নিশ্চিত করে।
সংগ্রহের চিত্র (২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত):
খারিফ বিপণন মরসুমে ২০২৪-২৫-এ ৮১৩.৮৮ লক্ষ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহ হয়েছে, যার ফলে ১.১৫ কোটি কৃষক উপকৃত হয়েছেন।
রবি বিপণন মরসুমে ২০২৫-২৬-এ ৩০০.৩৫ লক্ষ মেট্রিক টন গম সংগ্রহ হয়েছে, যার ফলে ২৫.১৩ লক্ষ কৃষক উপকৃত হয়েছেন।
কেন্দ্রীয় মজুত: ২০২৫ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত, কেন্দ্রীয় মজুতে নির্ধারিত নিয়মের চেয়ে বেশি পরিমাণে চাল (৩৭৭.৮৩ লক্ষ মেট্রিক টন) এবং গম (৩৫৮.৭৮ লক্ষ মেট্রিক টন) মজুত ছিল।
খোলা বাজার বিক্রয় প্রকল্প (OMSS): অতিরিক্ত খাদ্যশস্য (গম ও চাল) খোলা বাজারে বিক্রি করে বাজারের সরবরাহ বাড়ানো, দাম স্থিতিশীল রাখা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এর অধীনে ‘ভারত আটা’ এবং ‘ভারত চাল’ চালু করা হয়েছে।
ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা কাঠামো NFSM/NFSNM-এর মাধ্যমে উৎপাদন শক্তিশালীকরণ এবং NFSA/TPDS-এর মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত বন্টন নিশ্চিতকরণের দ্বৈত কৌশলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রযুক্তিগত সংস্কার এবং প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ অন্ন যোজনার মতো প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার দেশের প্রায় ৮১ কোটি মানুষের জন্য খাদ্যশস্যের সহজলভ্যতা ও সাশ্রয়ী মূল্য নিশ্চিত করে, যা ক্ষুধা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এক ঐতিহাসিক জয়।