কলকাতার দুর্গাপূজা (Kolkata Durga Puja) মানেই এখন থিমের নতুন নতুন চমক। শহর জুড়ে যখন বিদেশি স্থাপত্য আর চোখ ধাঁধানো লাইটিং-এর ছড়াছড়ি, তখন উত্তর কলকাতার এক পাড়া বেছে নিয়েছে এক অন্যরকম থিম। এই প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তাঁকে ছবিতে চিনবে না, কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বরের জাদুতে আজও মোহিত বাঙালি। মহালয়ার ভোরে যাঁর কণ্ঠস্বরে জেগে ওঠে বিশ্বজোড়া বাঙালি, সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবার মৃত্যুর ৩৪ বছর পর ফিরে আসছেন নিজের পাড়ায়।
উত্তর কলকাতা সর্বজনীন দুর্গোৎসব, যা এই বছর ৯৪ বছরে পা দিল, বিগত ৯৩ বছর ধরে সাবেকি পুজো করে এসেছে। কিন্তু এই বছর তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে থিমের জগতে প্রবেশ করার। তাঁদের থিম ভাবনা আর কেউ নন, স্বয়ং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত শ্যামবাজারের গলির গলি পেরিয়ে ৩০বি রামধন মিত্র লেন, যেখানে জন্ম হয়েছিল এই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পীর। তাঁর বাড়ির লাগোয়া রাস্তায় আয়োজিত এই পুজোয় এবার থিম হয়েছে তাঁরই জীবনের নানান দিক।
পুজোর মূল মণ্ডপটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বীরেন্দ্র মঞ্চ’, যেখানে বসবেন দশভুজা। পুরো মণ্ডপ জুড়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ৭০ বছর আগের এক সকালের চিত্র। বড়বাড়ির নাটমন্দির, ঠাকুর দালান তৈরির কাজ, উলটোদিকে আকাশবাণী—সবকিছুই শিল্পীর তুলির টানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দেওয়াল জুড়ে থাকছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণর অবয়ব এবং মহালয়ার নানা অনুষঙ্গ, যা এলইডি আলোয় আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। এমনকি, একটি পুরোনো সময়ের রকও তৈরি করা হয়েছে, যেখানে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ থেমে যাবে আকাশবাণীর গাড়ি—বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যাচ্ছেন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ পড়তে।
এই পুজোর মূল আকর্ষণ মহালয়ার ভোরে এর উদ্বোধন। একসময় যখন তৎকালীন গোঁড়া ব্রাহ্মণসমাজ বীরেন্দ্রকৃষ্ণর মতো অব্রাহ্মণের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠের বিরোধিতা করেছিলেন, তখন শ্রোতাদের বিপুল চাপে ১৯৩৬ সাল থেকে আবারও মহালয়ার ভোরে এই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক জনপ্রিয়তাকে সম্মান জানাতেই পুজোর উদ্বোধন হবে মহালয়ার কাকডাকা ভোরে।
জীবনের শেষ দিকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের আক্ষেপ ছিল, তিনি অনেক কিছুই পাননি। কিন্তু আজ যখন তাঁর পাড়ায় বাজছে, ‘পেঁজা তুলোর মেঘ দিয়েছে নীল আকাশে পাড়ি। ঢাকের বোলের তালে এল দুগ্গা বাপের বাড়ি..’—তখন যেন তাঁর সেই আক্ষেপ মিটে যাচ্ছে। এই বছর উত্তর কলকাতার এই পুজোটি কেবল একটি উৎসব নয়, এটি এক কিংবদন্তি শিল্পীকে দেওয়া এক অসাধারণ শ্রদ্ধাঞ্জলি।