তারিখ ১৬ জুন। পাকিস্তান কোনও মতে আয়ারল্যান্ডকে হারাল। ইতিমধ্যেই বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গিয়েছে পাকিস্তান (Pakistan Cricket)। এই ম্যাচটি ছিল যুদ্ধের মতো। এই ম্যাচে পাকিস্তানকে প্রমাণ করতে হত যে, আমেরিকার বিরুদ্ধে তাদের একটি ম্যাচ খারাপ হয়েছিল, অন্যথায় তারা সুপার আটে জায়গা করেই নিত। কিন্তু এটা প্রমাণ করার পরিবর্তে মনে হচ্ছিল ২০০৭ সালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে। ২০০৭ সালের বিশ্বকাপের মতো আয়ারল্যান্ডও ২০২৪ সালের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে দিতে পারত। শাহিন শাহ আফ্রিদি সময়মতো দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে সেই সুযোগ আসতে দেননি। এই জয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে বাবর আজমকে আক্রমণাত্মক অবস্থায় দেখা যায়।
বাবর আজম প্রেস কনফারেন্সে বলেন, “আমি ফিরে আসার পর এখানে কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে কথা বলব। যদি আমাকে অধিনায়কত্ব ছাড়তে হয়, আমি সবার সামনে সিদ্ধান্ত নেব। আমি লুকিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নেব না। পিসিবি আমাকে আবার অধিনায়কত্ব দিয়েছিল। এখন তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দল হিসেবে আমরা হেরে যাচ্ছি। এটা শুধু একজন খেলোয়াড়ের কারণে নয়। শুধু অধিনায়কত্ব নিয়ে কথা বলা ভালো নয়। আমি সব খেলোয়াড়ের জায়গায় গিয়ে খেলতে পারি না। দলে ১১ জন খেলোয়াড় রয়েছে, প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নিজস্ব ভূমিকা রয়েছে। আমি মনে করি, দল হিসেবে আমরা ভালো করতে পারিনি।”
অধিনায়ক বাবর আজম ১১ জন খেলোয়াড়ের পরিবর্তে একা খেলার কথা বলে ফেললেন, কিন্তু সম্ভবত ভুলে গিয়েছিলেন যে পরিসংখ্যান তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করে না। বিশ্বকাপের ৪ ম্যাচে ১২২ রান করেছেন বাবর। তার স্ট্রাইক রেট ছিল ১০১.৬৬। আর কিছু বলিবার প্রয়োজন নাই।
২০২৩ সালের বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের অধিনায়কের পদ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছিল বাবর আজমকে। যাইহোক, এই ধরনের ক্ষেত্রে নিজে থেকে এগিয়ে এসে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা খুব কমই ঘটে থাকে। বোর্ডের তরফে এই ক্ষেত্রে এমন অফার দেওয়া হয়ে থাকে যে, অধিনায়ককে সরিয়ে দেওয়া হলেও তাকে প্রেসের সামনে এই কথা বলার সুযোগ দেওয়া হবে যে, তিনি নিজে থেকেই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন।
বাবর আজমকে সরিয়ে দেওয়ার পর, শান মাসউদকে টেস্ট দলের অধিনায়ক করা হয় এবং শাহিন শাহ আফ্রিদিকে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের দায়িত্ব দেওয়া হয়। শাহিন শাহ আফ্রিদির নেতৃত্বে পাকিস্তান নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে একটি সিরিজ খেলেছিল। সেই সিরিজেও পাকিস্তান বাজে ভাবে হেরেছিল। এর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আসার সঙ্গে সঙ্গেই অধিনায়কত্ব ফিরে পান বাবর আজম। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বহু প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু সেই প্রশ্নগুলির আগে, আমি আপনাকে অধিনায়ক হিসাবে বাবর আজমের পরিসংখ্যান বলি।
বাবর ২০টি টেস্টে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে ১০টিতে জিতেছেন তিনি। ৬টি ম্যাচ জিতেছে এবং ৪টি হেরেছে। জয় ও পরাজয়ের হার ৫০ শতাংশ। ৪৩টি একদিনের ম্যাচে ভারত ২৬টি জিতেছে এবং ১৫টিতে হেরেছে। ১টি ম্যাচ টাই। জয়ের হার ৬৩.০৯ শতাংশ। টি২০ ভারতের ৮৫টি ম্যাচে ৪৮টি জয় এবং ২৯টি পরাজয় রয়েছে। ১টি ম্যাচ টাই হয়েছিল এবং ৭টি ম্যাচের কোনও ফলাফল হয়নি। জয়ের হার ৬২.১৭ শতাংশ। বিশ্বকাপের ম্যাচে বাবর আজমের অধিনায়কত্বের কথা বললে, ওয়ানডেতে ৯ ম্যাচে তাঁর ৪টি জয় এবং ৫টি পরাজয় রয়েছে। ১৭টি টি২০-এ তারা ১১টি জিতেছে, ৫টি হেরেছে এবং ১টি অমীমাংসিত। জয়ের হার ৬৭.৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ, প্রায় সব ফরম্যাটেই বাবরের জয়ের হার ৫০ শতাংশের বেশি। একমাত্র তিক্ত সত্যটি হল যে তারা একটি বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে।
এখন বাবর আজমকে আবার অধিনায়ক করা হলে যে প্রশ্নগুলি উত্থাপিত হয় সে সম্পর্কে কথা বলা যাক। প্রশ্নটি বেশ সোজা, ২০২৩ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের পরাজয়ের জন্য যদি বাবর আজম দায়ী হন, তাহলে ২০২৪ সালে কেন তাকে দায়িত্ব দেওয়া হল? অন্যদিকে, বাবর আজম যদি অধিনায়কত্ব ছেড়ে দিতেন, তাহলে ৬-৭ মাসে এমন কী হল যে তিনি আবার এই কঠিন দায়িত্ব সামলানোর যোগ্য হয়ে উঠলেন? আসল গল্পটি হল যে পাকিস্তান ক্রিকেট কিছু সময়ের জন্য প্রচণ্ড লবি বাজির শিকার হয়েছে। লাহোর করাচির একটি লবি। প্রাক্তন খেলোয়াড়দের একটি লবি। পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের একটি লবি। কিছুদিনের মধ্যেই গ্যারি কার্স্টেন এই বিষয়টি বুঝতে পেরে গিয়েছিলেন। এইজন্যই হয়ত তিনি বলেছিলেন, ‘দলে সব কিছু ঠিক চলছে না।’
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে সাম্প্রতিক অতীতে প্রায় সব বড় টুর্নামেন্টেই পাকিস্তান পিছিয়ে পড়তে পারত না। জিম্বাবোয়ে দল কখনও পাকিস্তানকে পরাজিত করে। কখনও তারা প্রথমবারের মতো আইসিসি টুর্নামেন্টে খেলা মার্কিন দলের কাছে পরাজিত হয়। আর সর্বনাশের শেষটা করার জন্য আছে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড স্বয়ং। টুর্নামেন্ট চলার মাঝেই বোর্ডের কর্তারা বিবৃতি দিয়ে দেন যে, পরাজয়ের পরে একটি ছোট অস্ত্রোপচার করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু, এখন মনে হচ্ছে পরাজয়ের পর মনে হচ্ছে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার করতে হবে। আর এতেই মাঠে নামার আগে খেলোয়াড়দের মনে ভয় কাজ করতে থাকে।
এই সবকিছুর ফলাফল এখন সবার সামনে। টি২০ বিশ্বকাপে পাকিস্তান গ্রুপ লিগ থেকেই বিদায় নিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াগুলিতে পাকিস্তানি খেলোয়ার ও বোর্ডকে নিয়ে চলছে ট্রোলিং। কিছুদিন বাদেই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ খেলবে পাকিস্তান। সেই সিরিজে বাবর আজমকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দেওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।