॥ চা চাষের মধ্য দিয়ে শুরু করে গড়েন ১৬ প্রতিষ্ঠান ।।
আবু আলী, ঢাকাঃ বাংলাদেশের ব্যবসায়ী জগতের উজ্জল নক্ষত্রের বিদায় হয়েছে। ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা, সুনাম আর সততার স্বীকৃতি পাওয়া লতিফুর রহমান ১ জুলাই বুধবার পৈত্রিক বাসভবন কুমিল্লায় মারা গেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তার মৃত্যুতে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্বে থেকে সমাজের বিশিষ্ট নাগরিকরা শোক জানিয়েছেন। বুধবার এশার নামাজের পর রাজধানীর গুলশান সেন্ট্রাল মসজিদ (আজাদ মসজিদ) এ তার জানাজার পর রাতেই বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। লতিফুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছিলেন। তিনি ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। মৃত্যুও সময় স্ত্রী শাহনাজ রহমান, তিন মেয়ে সিমিন হোসেন, শাজরেহ হক ও শাজনীন রহমান এবং এক ছেলে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
লতিফুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারের পরিচালনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়াওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও দৈনিক প্রথম আলোর পরিচালনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়াস্টারের চেয়ারম্যান ছিলেন। ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লতিফুর রহমান। বাংলাদেশের স্বনামধন্য ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বেভারেজ, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স পণ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, ফাস্ট ফুড, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য, গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও এফএম রেডিও) এবং চা বাগানের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
ট্রান্সকম গ্রুপের মধ্যে রয়েছে, ট্রান্সকম বেভারেজ, ট্রান্সকম ইলেকট্রনিক্স, এসকেএফ ফার্মাসিটিক্যালস, ট্রান্সকম ফুড, ট্রান্সকম ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, ট্রান্সকম কনজ্যুমার প্রোডাক্ট ও মিডিয়াস্টার।
লতিফুর রহমান আইসিসি প্যারিসের নির্বাহী বোর্ডের সদস্য, আইসিসি বাংলাদেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ব্র্যাকের পরিচালনা কমিটির সদস্য। তিনি বাংলাদেশ বেটার বিজনেস ফোরাম এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার উপদেষ্টা কমিটির সদস্য।
লতিফুর রহমান ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাত বারের প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ এপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন।
এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ সরকারের ট্রেড বডি রিফর্মস কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী বোর্ডের সদস্য ছিলেন।
লতিফুর রহমান ‘অসলো বিজনেস ফর পিস অ্যাওয়ার্ড ২০১২’ তে ভূষিত হন। এবং অ্যামেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ ২০০১ সালে তাকে বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ারে সম্মানিত করে।
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ‘সার্ক আউটস্ট্যান্ডিং লিডার’ সম্মাননা পেয়েছেন। নৈতিকতার সঙ্গে ব্যবসায় অবদানের জন্য যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশিদের শীর্ষ ব্যবসায়ীক সংগঠন ইউকে বাংলাদেশ ক্যাটালিস্ট অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ তাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করে।
পারিবারিক সূত্র জানিয়েছে, চা চাষের মধ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। তার দাদা খান বাহাদুর ওয়ালিউর রহমান ১৮৮৫ সালে আসামে কিছু জমি কিনে চা-বাগান শুরু করেন। তখন চা-বাগানের মালিক ছিল মূলত ব্রিটিশরা। দাদার চা-বাগানই ছিল স্থানীয় কারও মালিকানার প্রথম বাগান। লতিফুর রহমানের দাদা খান বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। বাবা মুজিবুর রহমানের জন্ম সেখানেই। কলকাতায় লেখাপড়া করে আসামের তেজপুরে ফিরে সেখানেই জমি কিনে চা-বাগান তৈরি করেন। তার বাবাও খান বাহাদুর উপাধি পান। দেশভাগের পর সবাই চলে আসেন ঢাকায়। ১৯৫১ বা ৫২ সালের দিকে সিলেটে নতুন করে চা-বাগান করেন। পাটের ব্যবসাও শুরু করেন।
লতিফুর রহমানের জন্ম জলপাইগুড়িতেই, ১৯৪৫ সালের ২৮ আগস্ট। দুই বোনের পর তাঁর জন্ম। পরে আরও এক বোন ও এক ভাই আছেন। ঢাকায় থাকতেন গেন্ডারিয়ায়। ছোটবেলায় পড়তেন সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে। সেখান থেকে চলে যান হোলিক্রস স্কুলে। সে সময় হোলিক্রসে ছেলেরাও পড়ত। ১৯৫৬ সালে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলংয়ে। সেন্ট এডমন্ডস স্কুলে ভর্তি হলেন ক্লাস থ্রিতে। সেখান থেকে কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে।
সময়টা তখন উত্তপ্ত। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। এসব কারণে ঢাকায় ফিরে এলেন লতিফুর রহমান। এসে ঢুকে গেলেন পাটের ব্যবসায়। বাবা তখন চাঁদপুরে গড়ে তুলেছেন ডব্লিউ রহমান জুট মিল। ১৯৬৩ সালে কাজ শুরু হলেও উৎপাদন শুরু হলো ১৯৬৬ সালে। ‘সেখানে আমি ট্রেইনি হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। দেড় বছর কাজ শেখার পর একজন নির্বাহী হিসেবে যোগ দেন।
১৯৭১ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৭২ সালে ডব্লিউ রহমান জুট মিল জাতীয়করণ করা হয়, যেটি ছিল রহমান পরিবারের অন্যতম আর্থিক খাত। পরের বছর ১৯৭৩ সালে ট্রান্সকম গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন লতিফুর রহমান। আশির দশকে বাংলাদেশে নেসলের একমাত্র আমদানিকারক ও পরিবেশক ছিলেন লতিফুর রহমান। ৯০ এর দশকে তিনি দেশে মার্কিন ফার্মাসিটিক্যাল স্মিথ, ক্লাইন অ্যান্ড ফ্রেঞ্চ নিয়ে আসেন, পরবর্তীতে যা এসকেএফ নামে পরিচিতি পায়।