প্রণব বিশ্বাস: যে “খেলা হবে” স্লোগান তুলে গতবছর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে ঝড় তুলেছিল রাজনৈতিক দলগুলি, এবার সেই স্লোগানই ব্যবহার করছে রাজ্যের মাধ্যমিক পরীক্ষার ছাত্র-ছাত্রীরা।
গত মাসে রাজ্যজুড়ে যে মাধ্যমিক পরীক্ষা হয় তাতে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরা “খেলা হবে” স্লোগানটি কোনও না কোন ভাবে ব্যবহার করেছে যা দেখে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
এই মুহূর্তে চলছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কিন্তু সেই পরীক্ষায় কোনও ছাত্র-ছাত্রী যাতে এই স্লোগানটি কে ব্যবহার করতে না পারে বা নিজেদের উত্তরপত্রে ব্যবহার করতে না পারে সে জন্য সতর্কবার্তা কিংবা বলা যেতে পারে একপ্রকার সতর্ক করল উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ। কোনও ছাত্র-ছাত্রী যদি এই ধরনের রাজনৈতিক স্লোগান তাদের উত্তরপত্র এ ব্যবহার করে তবে তার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না পর্ষদ।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নাম না নিয়েও একাধিকবার কার্যত হুমকির সুরে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল “খেলা হবে…”। বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের ডাকসাইটে আওয়ামী লীগ সাংসদ শামীম ওসমানের মুখে ছোট্ট এই দুটো শব্দই যে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠবে তা কে জানতো ?
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ঝড় তুলেছিল এই স্লোগান। পরবর্তী সময়ে রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে ত্রিপুরা, অসম, উত্তরপ্রদেশ সহ বেশ কিছু রাজ্যেও উচ্চারিত হতে থাকে এই শ্লোগান। নির্বাচনী প্রচারণার সময় রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে বলতে শোনা গিয়েছিল “আসুন খেলা হবে”। এমনকি প্রচারণার সময় নন্দীগ্রামে পা ভেঙে যাওয়ার পর তিনি বলেছিলেন “আসুন ভাঙ্গা খেলা হবে”। দলের নেতা-নেত্রীরা তাদের নিজস্ব কায়দায় “খেলা হবে” শ্লোগান ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। কেউ আবার বলেছিলেন “ভয়ঙ্কর খেলা হবে”।
থেমে থাকেনি রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিআইএম’এর নেতা-নেত্রীরারাও। এই স্লোগানকে কেন্দ্র করে ভোটের সময় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। নানা কারণে-অকারণে এই স্লোগান ব্যবহার করেই প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে হুমকি দিতেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
একটা সময়ে হুমকি, চ্যালেঞ্জ, গান-প্যারোডি, সোশ্যাল মিডিয়া, পোস্টারে খেলা হবে স্লোগান দেওয়াটা ট্রেন্ড হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই স্লোগানেকে থিম করেই গতবছর কলকাতার দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলও করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, রাস্তাঘাটে পরিচিত কেউ কাউকে দেখলেই “খেলা হবে” বলেও সম্বোধন করতে দেখা গিয়েছিল।
আর এখন স্কুলের শিক্ষার্থীরাও পর্ষদের পরীক্ষার উত্তর পত্রে এই স্লোগান ব্যবহার করছে। যা নিয়ে উদ্বিগ্ন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষা পর্ষদ।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ কর্তৃক পরিচালিত দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ তাদের উত্তর পত্রে ওই জনপ্রিয় রাজনৈতিক স্লোগান লেখে বলে অভিযোগ। গত মাসেই রাজ্যজুড়ে মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সব উত্তরপত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা দেখেন যে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী তাদের উত্তরপত্রে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের স্লোগান ‘খেলা হবে’ (একটি খেলা হবে) লিখেছে। আর তা দেখেই কার্যত হতবাক শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
বিষয়টি সামনে আসতেই নড়েচড়ে বসেছে রাজ্যটির উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBCHSE)। রাজ্যে চলমান উচ্চ মাধ্যমিক (দ্বাদশ শ্রেণী) পরীক্ষার শিক্ষার্থীদের সতর্ক করেছে তারা।
গত ২ এপ্রিল থেকে শুরু হয়েছে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, তা চলবে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। এই পরীক্ষা পরিচালিত করে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ (WBCHSE)। সেক্ষেত্রে কোন শিক্ষার্থী যদি তাদের উত্তরপত্রে এই ধরনের স্লোগান লেখে বা কোন ছবির মাধ্যমে তা বোঝাতে চায়, সেই সব শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তা না হলে, আগামী দিনে যেকোনো পরীক্ষাতেই শিক্ষার্থীরা ঠিক একই ভুল করতে পারে বলে ধারণা।
এব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রেসিডেন্ট চিরঞ্জীব ভট্টাচার্য জানান “এই ধরনের উত্তরপত্র মূল্যায়ন না করতে পরীক্ষকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী এই ধরনের বিষয় লিখবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউন্সিল কর্তৃক গঠিত একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করবে।”তিনি আরো জানান “রাজনৈতিক স্লোগান লেখা, প্রচারণা বা বিতর্কিত বিষয় যা WBCHSE-এর নিয়ম ও নির্দেশিকা লঙ্ঘন করে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিশ্চিত।”
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। তার অভিমত “কোনো ক্ষমতাসীন দলেরই শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনীতি করা উচিত নয় এবং সংবেদনশীল মনকে প্রভাবিত করা উচিত নয়।”