নিজস্ব প্রতিনিধি,ঝাড়গ্রাম: রাতের অন্ধকারে মায়ের সাথে বেরিয়েছিল খাবারের সন্ধানে। কিন্তু সেই খাবার খেতে বেরিয়েই চরম বিপত্তির মুখে পড়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। কিন্তু মায়ের আপ্রাণ চেষ্টা, বনকর্মীদের প্রয়াস আর স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতনতায় প্রাণ ফিরে পেয়ে অক্ষত অবস্থায় ফের মায়ের আশ্রয় পেল এক হস্তিশাবক। নিজের সন্তান কে কাছে ফিরে পেয়ে মনের আনন্দে ফের ফিরে গেল জঙ্গলে। মা সন্তানের এমনই এক বিয়োগান্তক আর মিলনান্তক ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকলো এলাকাবাসী।
লালগড়ের ঝিটাকার জঙ্গলে প্রায় ৬-৭ দিন ধরে একটি হাতির পাল রয়েছে। সারাদিন জঙ্গলে কাটালেও রাতের অন্ধকারে হামলা চালাচ্ছে আলু সহ নানান সব্জির ক্ষেতে৷ ফলে একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন এলাকার চাষীরা তেমনই আতঙ্কেও কাটাতে হচ্ছে তাদের। এরই মাঝে এদিন সাত সকালেই কুয়োর মধ্যে এক হস্তি শাবকের পড়ে যাওয়ার ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়।
ঘটনাটি ঘটেছে ঝাড়গ্রামের লালগড় রেঞ্জের লালগড় বীটের সখীশোল গ্রামে। স্থানীয় বাসিন্দারা দেখেন গ্রামের একপ্রান্তে মাঠের মাঝে একটি কুয়োর পাশে দুটি হাতি ঘুরাঘুরি করছে। তাতেই সন্দেহ হওয়াতে তারা লক্ষ্য করেন একটি বাচ্চা হাতি কুয়োর মধ্যে পড়ে রয়েছে। সাথে সাথে তারা বনদপ্তরে জানালে বনকর্মীরা পুলিশি সহায়তায় বাচ্চা হাতিটিকে উদ্ধার করে মা হাতির কাছে ফেরত পাঠায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বেশ কয়েকদিন ধরেই ঝিটকার জঙ্গলে ৩০-৩৫ টি হাতির একটি পাল রয়েছে৷ তারাই খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে প্রতিদিন৷ গতকাল রাত্রীতেও এই পাল হাতিটি সখীশোল, আমডাঙ্গা প্রভৃতি গ্রামের মাঠে খাবার খেতে বেরিয়ে ছিল৷ সেই পাল হাতির মধ্য থেকেই একটি মা হাতি তার বাচ্চাকে আর অন্য একটি পুরুষ হাতিকে সঙ্গে নিয়ে পাল থেকে আলাদা হয়ে সখীশোলের মাঠে থেকে যায়৷ বাচ্চা হাতিটি তার মায়ের সঙ্গে খাবার সন্ধান কারতে গিয়েই মাঠের মাঝখানে থাকা একটি অগভীর কুয়োতে পা হড়কে পড়ে যায়। কুয়োর মধ্যে থেকেই প্রাণ বাচানোর জন্য চিৎকার করে মায়ের কাছে সাহায্য চাই৷
মা হাতিটিও তার সন্তান কে বাচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। সামনের দুপা কুয়োতে নামিয়ে শুড় বাড়িয়ে বার বার চেষ্টা করলেও সফল না হওয়াতেই সারা রাত্রী ওই কুয়োর চারিদিকে ঘুরাঘুরি করতে থাকে। এদিন স্থানীয় বাসিন্দারা বিষয়টি জানতে পেরেই বনদপ্তরে জানায়৷ এদিকে হাতির বাচ্চা কুয়োতে পড়েছে এই খবর চাউর হতেই এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি উৎসুক জনতার ভীড় জমে যায়। প্রায় হাজার খানেক মানুষের জমায়েত হয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায় লালগড় রেঞ্জের বনকর্মীও লালগড় থানার পুলিশ কর্মীরা। এদিকে উৎসুক জনতাকে কুয়োর কাছাকাছি যেতে বারণ করা সত্ত্বেও কুয়োর কাছাকাছি চলে যায় জনতা। আর যখনই মানুষ কুয়োর খুব কাছাকাছি চলে যাচ্ছে তখনই মা হাতিটি তাড়া করে হটানোর চেষ্টা করে সবাইকে।
মা হাতির এই তাড়া খেয়ে হতাহত কেউ না হলেও মা হাতির হামলা চালিয়ে তিনটি মোটর সাইকেল ও দুটি সাইকেল ভাঙ্গে ফেলে। পরে পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে তিনটি জেসিবি মেশিন দিয়ে কুয়োর চারপাশের মাটি কেটে বাচ্চা,হাতিটিকে উদ্ধার করে। তবে বন আধিকারিকরা বার বার জনতা কে নিষেধ করেই উদ্ধার হওয়া সেই বাচ্চা টির গায়ে যেন কেউ হাত না দেয়৷ কারন তার গায়ে মানুষের ছোয়া লাগলে তাকে আর ফিরিয়ে নেয় না হাতিরা। বন আধিকারিকদের এই কথা অবশ্য রাখেন উৎসুক জনতা৷ কেউ হাতির গায়ে হাত দেয়নি৷ উদ্ধার করার সময় যেটুকু হাত পড়েছিল তার জন্য হাতিটিকে ধুলো মাখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ফলে তাকে নিজেদের সাথে নিতে কোনো সমস্যা হয়নি৷ আর এদিকে মা তার সন্তান কে কাছে ফিরে পেয়্ব নেজ নাড়াতে নাড়াতে দুলকি চালে ফিরে যায় জঙ্গলে৷
হাতির উদ্ধার হওয়া দেখতে এসেছিলেন ঝিটকার বাপ্পা মাহাত৷ তিনি জানান, আমরা জানতাম হাতির গায়ে মানুষ হাত দিলে তাকে আর দলে ফিরিয়ে নেই না৷ ফলে সে দলছুট হয়ে পড়ে৷ এতে আমাদের হিতে বিপরীত হয়ে পড়ে৷ তাই উদ্ধার হওয়ার পর এই বাচ্চা হাতিটির গায়ে সাধারণ মানুষ কেউ হাত না দিয়ে নিজেদের সচেতনতার পরিচয় দিয়েছে।
কর্তব্যরত এক বনকর্মী বলেন, বাচ্চাটি যে কুয়োর মধ্যে পড়েছিল সেই কুয়োর গভীরতা ছিল পনের ফুটের মতো৷ কিন্তু কুয়োতে জল ছিল না বলেই আমরা হাতিটিকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে জঙ্গলে ফেরৎ পাঠাতে পেরেছি৷ না হলে হয়তো অন্যকিছু ঘটে যেতে পারতো৷ তবে সাধারণ মানুষ যে সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন তাতে তাদের বাহবা দিতেই হয়।