West Bengal in Crisis: রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতি কেন্দ্র থেকে কি পশ্চিমবঙ্গ আজ নারী নির্যাতনের কেন্দ্রস্থল!

কলকাতা: হুগলী নদীর তীরে অবস্থিত, এককালে রবীন্দ্রনাথের প্রভাবে ভারতের সংস্কৃতি ও সৃজনশীলতার কেন্দ্রভূমি পশ্চিমবঙ্গ আজ এক অন্ধকার বাস্তবতার মুখোমুখি (West Bengal in Crisis)- যা ভয় এবং অরাজকতায় পূর্ণ।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস (TMC)-এর তেরো বছরের শাসনে, রাজ্যটি এক ‘ধর্ষণ রাজ্য’ (Rape State) হিসাবে কুখ্যাতি অর্জন করেছে, যেখানে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ একটি ব্যাপক এবং গভীরভাবে প্রোথিত মহামারীতে পরিণত হয়েছে।

ভয়াবহ পরিসংখ্যান: বিচারহীনতার আঁধার

ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB) ২০২২-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৩৪,৭৩৮, যা রাজ্যটিকে সারা দেশে সর্বোচ্চগুলির মধ্যে স্থান দিয়েছে। প্রতি ১ লক্ষ মহিলার মধ্যে ৭১.৮টি ঘটনা ঘটেছে, যা জাতীয় গড়ের (৬৬.৪) চেয়ে বেশি। শুধুমাত্র ধর্ষণের মামলাই ছিল ৩,০০০-এর বেশি।

পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। ২০২৩ সালের প্রাথমিক রিপোর্টে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ ১৫.৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত রাজ্য পুলিশ ৪,০০০-এরও বেশি ধর্ষণ ও হামলার ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের মোট সংখ্যা ৪০,০০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে—২০২২ সালের তুলনায় যা ২০% বৃদ্ধি। এই সংখ্যাগুলি কেবল পরিসংখ্যান নয়; এগুলি ভাঙা জীবন, স্তব্ধ কণ্ঠস্বর এবং একটি ব্যর্থ শাসনের প্রতিফলন, যেখানে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা জননিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এনসিআরবি (NCRB) তথ্য দেখায় যে পশ্চিমবঙ্গে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার মাত্র ১৭%, যা জাতীয় গড় (২৭%) থেকে অনেক কম। এই দুর্বল রেকর্ড অনেক অপরাধীকে—যাদের প্রায়শই টিএমসি-র সাথে যোগসূত্র থাকে—মুক্তি পেতে সাহায্য করেছে।

সাংগঠনিক নৃশংসতা ও রাজনৈতিক যোগসাজশ

রাজ্যের সঙ্কট সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে ধারাবাহিক কিছু নৃশংস ঘটনায়, যার প্রতিটিতেই রাজনৈতিকভাবে ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

আর.জি. কর ট্র্যাজেডি (আগস্ট ২০২৪): কলকাতার আর.জি. কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সেমিনার হলে ডিউটিরত অবস্থায় এক ৩১ বছর বয়সী পিজিটি ডাক্তার ‘অভয়া’-র (ছদ্মনাম) উপর সাংঘাতিক ভাবে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে বিবেককে নাড়িয়ে দেয়। এফআইআর (FIR) দায়ের করতে ১২ ঘণ্টারও বেশি দেরি করা হয়। টিএমসি-র ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ ওঠে। হাইকোর্ট সিবিআই (CBI)-কে তদন্তের নির্দেশ দিলেও, অভয়ার পরিবার এখনো বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করে আসছে।

জানুয়ারি ২০২৪, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ধর্ষণে সন্দেশখালি কান্ড:

সুন্দরবনের সন্দেশখালিতে টিএমসি ব্লক সভাপতি শেখ শাহজাহান ও তার দলের বিরুদ্ধে নারীরা উঠে এসে ধর্ষণের, জমি দখলের এবং অপহরণের অভিযোগ করেন। ৫৫ দিন ধরে শাহজাহান পলাতক ছিল। আদালতের নির্দেশে সিবিআই (CBI) মামলা হাতে নিলেও, অভিযোগ ওঠে যে টিএমসি ভয় দেখিয়ে ও ঘুষ দিয়ে ৫০ জনেরও বেশি মহিলাকে তাদের অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে।

কসবা ল’ কলেজ গণধর্ষণ (জুন ২০২৫):

আরজি কর ঘটনার দশ মাস পরে, সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে এক ২৪ বছর বয়সী আইন ছাত্রীকে মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে গণধর্ষণ করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ছিল টিএমসি-র ছাত্র শাখা তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (TMCP)-এর পরিচিত সদস্য মনোজিত মিশ্র। টিএমসি সাংসদ মানস ভুঁইয়া এবং বিধায়ক মদন মিত্রের মতো নেতাদের ‘ভিকটিম-ব্লেমিং’ মন্তব্য ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়, যা ক্যাম্পাসে টিএমসি-র ছাত্র শাখার বেপরোয়া প্রভাবকে তুলে ধরে।

সেপ্টেম্বর ২০২৫ -পাঁশকুরা হাসপাতালের সাংগঠনিক নির্যাতন :

পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুরা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ম্যানেজার জাহির আব্বাস খান, যিনি টিএমসি-র সঙ্গে যুক্ত বলে অভিযুক্ত, তাকে চুক্তিবদ্ধ মহিলা কর্মীদের ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। হাসপাতালের প্রশাসন অভিযোগগুলি ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল, এবং স্থানীয় নেতারা খানকে “সমাজকর্মী” বলে রক্ষা করার চেষ্টা করেন, যা বিচারহীনতার ধারাকে আরও জোরদার করে।

পাচারের কালো ছায়া ও দলীয় গুন্ডারাজ

পশ্চিমবঙ্গে মানব পাচারের ঘটনাও উদ্বেগজনক। ২০২২ সালে রাজ্যটি ১,২৬১টি পাচারের মামলা নিয়ে জাতীয় স্তরে তৃতীয় স্থানে ছিল। সম্প্রতি, কলকাতা পুলিশের অভিযানে ৯ জন নাবালিকা উদ্ধার হওয়ার ঘটনায় জানা যায় যে পাচারকারীরা স্থানীয় টিএমসি নেতাদের ২০% কাটমানি দিত সুরক্ষার বিনিময়ে।

মুর্শিদাবাদ (এপ্রিল ২০২৫)-এ ওয়াকফ (Waqf) সংশোধনীকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় মহিলাদের উপর হামলা ও মেয়েদের অপহরণের অভিযোগ ওঠে। আগস্ট ২০২৫-এ দিনহাটা-য় এক ৮ মাসের গর্ভবতী বিজেপি কর্মীকে “রাজনৈতিক বিরোধিতার” জন্য টিএমসি দুষ্কৃতীরা পেটে লাথি মারে।

মুক্তির আহ্বান: বাংলার আত্মাকে পুনরুদ্ধার

২০২৫ সালের অক্টোবর গভীর হওয়ার সাথে সাথে, বাংলা এক কঠিন নৈতিক ও প্রশাসনিক চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। আর.জি. করের রক্তমাখা হল থেকে সন্দেশখালির বিধ্বস্ত মাঠ, কসবার ধর্ষিত শ্রেণিকক্ষ থেকে বুরটোলার পাচার হওয়া নাবালিকারা—সবই টিএমসি-র একচ্ছত্র আধিপত্যের অধীনে সন্ত্রাসের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে। যে ‘দেবী ক্ষেত্র’ একসময় শ্রদ্ধার আসনে ছিল, তা আজ হতাশায় পর্যবসিত। যেখানে মহিলাদের কান্না শোনা যায় না, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার হার ১৭%-এ আটকে আছে, এবং অপরাধীরা প্রায়শই দলীয় পরিচয় নিয়ে অবাধে ঘুরে বেড়ায়।

২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসছে। এই রাজ্যকে জবাবদিহিতার অগ্নিপরীক্ষায় পড়তে হবে। বাংলা কি এই বিচারহীনতাকে মেনে নেবে, নাকি ন্যায়বিচার ও পরিবর্তনের দাবি তুলবে?

সিবিআই এবং জাতীয় মহিলা কমিশন (NCW)-এর মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির অবিলম্বে এবং কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ করা জরুরি। একই সঙ্গে, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে ফাস্ট-ট্র্যাক আদালত গঠন এবং শক্তিশালী সাক্ষী সুরক্ষা সহ কঠোর আইনি সংস্কার প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের মহিলারা কেবল শিকারদের জন্য ন্যায়বিচার নয়, বরং তাদের নির্যাতনকারীদের রাজনৈতিক সুরক্ষা অবসানের দাবি জানাচ্ছে।