দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের (Bangladesh) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দীর্ঘ ১৫ বছরের ‘গণতন্ত্রহীনতায়’ দেশের যে পরিস্থিতি হয়েছিল তা থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ গ্রহণে তার সরকার প্রস্তুত। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফল ধরে রাখতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।
তিনি বলেছেন,দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। রাতারাতি এ অবস্থা থেকে উত্তরণ কঠিন। বর্তমান সরকারের দুই সপ্তাহ শেষে জনগণের যে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে তা অনুপ্রেরণামূলক। এমতাবস্থায় সরকারকে ‘জোড় করে’ দাবি আদায়ের চেষ্টা না করারও অনুরোধ করেন তিনি।
দায়িত্ব নেওয়ার ১৭ দিনের মাথায় রবিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ কথা বলেন বাংলাদেশের (Bangladesh) অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তার এই ভাষণ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর ৮ অগাস্ট শপথ নেয় মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
আন্দোলনে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর এখন বিভিন্ন পক্ষ নানা দাবি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে।
এভাবে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাজে বাধা না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে ইউনূস বলেন, “একটা বিশেষ ব্যাপারে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশেপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে।
“গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ- কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন, তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সকল পথ বন্ধ হয়ে থাকবে।”
“কিন্তু আমাদেরকে ঘেরাও করে এই গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোকে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না।“
ঘেরাও কর্মসূচি ও সমাবেশের মত যেসব কর্মসূচি চলছে, তা বন্ধে সকলের সহযোগিতা চেয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, “সবাই মিলে তাদের বোঝান তারা যেন এসময়ে তাদের অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা না দেন।”
বিগত সরকারের সময়ে ‘দলীয়করণের ফলে হওয়া বৈষম্য দূরীকরণ’ এবং প্রশাসনে গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতেও সকলকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানান তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আপনারা লক্ষ্য করেছেন, দায়িত্ব গ্রহণ করেই আমাদেরকে আইন-শৃঙ্খলা অঙ্গনে অস্থির পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে। আপনাদের সহযোগিতা ও সমর্থনে দেশপ্রেমিক সকল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজে যোগ দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকার প্রশাসনে চরম দলীয়করণ করার ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।
“আমরা ইতোমধ্যে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আরম্ভ করেছি। তবে প্রশাসনকে গতিশীল রাখতে এবং একই সাথে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সময় প্রয়োজন। সেজন্য সকলকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ জানাচ্ছি।“
প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো যেন জনগণের আস্থা ফিরে পায় সেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম উদ্দেশ্য জানান তিনি।
সরকার পতনের পর থেকেই ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে সচিবালয়কেন্দ্রিক মিছিল, বিক্ষোভ ও অবরোধ। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র এই কেপিআই অবকাঠামোর ভেতরে সরকারি কর্মচারীরাও নিয়মিত বিক্ষোভ করছেন।
পুলিশের দুর্বল প্রতিরোধ অতিক্রম করে একজোট হয়ে মানুষ ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন, মিছিল করছেন, কর্মীদের বের হতেও বাধা দিচ্ছেন।
এর ধারাবাহিকতায় রোববার চাকরি জাতীয়করণের দাবি নিয়ে আনসার সদস্যদরাও সচিবালয় ঘেরা করেন। ফলে সারাদির ভেতরে অবরুদ্ধ থাকেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
গেল ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার পর প্রথম কর্মদিবস ১১ অগাস্ট থেকেই প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীরা পদোন্নতি, বদলি ঠেকানো, চাকরি স্থায়ীকরণ ইত্যাদি দাবি নিয়ে নিয়মিত মিছিল করে যাচ্ছেন।
বুধবার সকাল থেকে সচিবালয়ের পশ্চিম পাশের ফটকে নার্স ও মিডওয়াইফরা অবস্থান নেয়। বদলির হয়রানি দূর করা এবং বদলির ক্ষমতা মন্ত্রণালয় থেকে নার্সিং অধিদপ্তরে ফেরত নেওয়ার দাবি জানাতে থাকেন তারা।
এরই মাঝে মঙ্গলবার দুপুরেও কয়েক হাজার কলেজ পড়ুয়া মিছিল নিয়ে ঢুকে পড়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানানোর ঘটনাও ঘটে। দাবির মুখে সন্ধ্যায় পরীক্ষা বাতিলের লিখিত ঘোষণা দিলেও শিক্ষার্থীরা আরও ঘণ্টাখানেক সময় সচিবালয়ে ঘোরাফেরা করতে থাকেন।
আন্দোলনকারী ছাত্রদের সচিবালয়ে প্রবেশের ঘটনাকে তখন ‘অনভিপ্রেত’ বলেছেন শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এদিকে সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও সমর্থকদের মধ্যে যারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, আদালতে নেওয়ার সময় তারা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। এনকি শুনানির সময় বাধা দেওয়া হচ্ছে।
শনিবার বিকেলে বাংলাদেশের (Bangladesh) প্রাক্তন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে আদালতে তোলা হলে তাকে লক্ষ্য করে ডিম ও জুতো ছুড়তে দেখা যায় উত্তেজিত জনতাকে। এর আগে একই ধরনের ঘটনার শিকার হন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং প্রাক্তন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আদালতে নেওয়ার পর তাদের দিকে ডিম ছুঁড়েছেন উপস্থিত আইনজীবীরা। ঝাড়ু হাতে মিছিল করেছেন আইনজীবীদের একটি দল।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে ‘হুমকি, চাপ ও হামলা করার প্রবণতা’ থেকে বেরিয়ে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গিয়েছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। আজ আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি। শুধু আমি বলব, আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
“এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তি বিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তাকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই এক ধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা তা থেকে বের হতে হবে। ছাত্র জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে ম্লান হয়ে যাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্ঠাও এতে ব্যহত হবে।”