খবর এইসময়,নিউজ ডেস্কঃ সাধারণত কোন নির্বাচনের আগেই নামি-দামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিতে যোগ দেওয়া কিংবা এক দল ছেড়ে আরেক দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা চোখে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক প্রতিটি নির্বাচনেও এই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে গত মার্চ-এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত বিধানসভার নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রায় প্রতিদিনই পালা করে রাজ্যটির ক্ষমতাসীন দল তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে মন্ত্রী-সাংসদ-বিধায়ক-কাউন্সিলর-পঞ্চায়েত প্রধান থেকে শুরু করে দলের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরাও দলে দলে বিজেপিতে যোগ দিতে দেখা গেছে। দলবদলের হিড়িক দেখে অনেকেই মুচকি হেসে কটাক্ষ করেছিলেন যে তৃণমূল দল আদৌ থাকবে কি না!
গত ২ মে ভোটের ফল বের হয়, তাতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয়বারের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। এরপর সরকারও গড়ে তারা। কিন্তু ভোটপর্ব মিটলেও ফের দলবদলের হিড়িক! তবে এবার ছবিটা উল্টো। সাধারণত ভোট মিটলেই রাজনৈতিক দলগুলিতে যোগদানের পর্বে ভাঁটা পড়ে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম! বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগদানের হিড়িক পড়েছে কলকাতা থেকে জেলায় জেলায়।
ভারতের কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির লক্ষ্য ছিল বিধানসভার নির্বাচনে ২০০ আসন পার করে ক্ষমতায় আসবে। আসন সংখ্যা বাড়ানোর লক্ষ্যে ওই নির্বাচনে বাবুল সুপ্রিয়, লকেট চ্যাটার্জি, স্বপন দাশগুপ্ত, জগন্নাথ সরকার, নিশীথ প্রামানিক সহ কয়েকজন সাংসদকে দাঁড় করিয়ে চমক দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। কিন্তু ক্ষমতায় আসা তো দূরের কথা, মাত্র ৭৭ আসনে জয় পেয়েই তাদের বিজয় রথ থমকে যায়। জিতে মুখরক্ষা করে মাত্র দুই জন- জগন্নাথ ও নিশীথ।
সরকার গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়িত না হওয়ায় দল থেকে বিধানসভার নির্বাচনে জয়লাভ করা দুই সাংসদ জগন্নাথ ও নিশীথকে তাদের বিধায়ক পদ ছাড়তে বলা হয়। ফলে জগন্নাথ সরকার শাান্তিপুর ও নিশীথ প্রামাণিক দিনহাটার বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সাংসদ পদে বহাল থাকেন। আর বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা কমে হয় ৭৫।
এরপর জুন মাসেই পুত্র সাবেক তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়কে সাথে নিয়ে পুরানো দল তৃণমূলের ফিরে যান মুকুল রায়। তৃণমূলের একসময়ের নাম্বার-টু মুকুল চার বছর আগে বিজেপিতে যোগ দেন। বাবার দেখানো পথেই তৃণমূল ছাড়েন তার পুত্র শুভ্রাংশুও। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে ১৮ টি আসন জয়ের পিছনে মুকুলের অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচনে সেই মুকুলকেই কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে দাঁড় করায় বিজেপি। অন্যদিকে বিজপুর কেন্দ্রের প্রার্থী হন শুভ্রাংশু। তবে মুকুল জিতলেও পরাজিত হন শুভ্রাংশু। তবে নির্বাচনে জিতলেও তার সাথে বিজেপর সাথে দূরত্ব বাড়তে থাকে। অবশেষে ফল প্রকাশের এক মাসের মধ্যে মুকুলের তৃণমূলে ফিরতেই বিজেপির বিধায়কের সংখ্যা কমে হয় ৭৪।
মুকুল তৃণমূলের ফিরতেই বিজেপির অন্দরে ভাঙনের আশঙ্কা আরও তীব্রতর হয়। প্রায় চার মাস পর গত সোমবার ৩০ আগষ্ট আচমকাই তৃণমূলে যোগদান করেন বিজেপি বিধায়ক তন্ময় ঘোষ। কলকাতার তৃণমূল ভবনে এসে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা তুলে নেন বিষ্ণুপুরের বিজেপি বিধায়ক তন্ময়। আর সেই সাথেই বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৭৩-এ।
চব্বিশ ঘন্টা কাটতে না কাটতেই ফের ঝটকা গেরুয়া শিবিরে। ৩১ আগষ্ট তৃণমূলে যোগ দেন বাগদার বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। মুকুল রায়ের অনুগামী বলে পরিচিত বিশ্বজিৎ বেশ কিছুদিন ধরেই বেসুরো ছিলেন। সেক্ষেতে দলপরিবর্তন ছিল কেবল সময়ের অপেক্ষা। ফলে নির্বাচন শেষ হওয়ার মাত্র চার মাসেই বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ফের একবার কমে এখন ৭২-এ দাঁড়িয়েছে।
কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে আরও বেশকয়েকজন বিজেপি বিধায়ক তলে তলে তৃণমূলের সাথে যোগাযোগ রাখছেন। ফলে বিধায়কের সংখ্যা যদি আরও কমতে থাকে, তাহলে তা বিজেপির অন্দরেই অস্বস্তি বাড়াবে। এছাড়াও রাজ্যটির বিভিন্ন জেলাতেই বিজেপি ছেড়ে প্রতিনিয়ত অসংখ্য কর্মী-সমর্থক তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন।
তবে এখানেই শেষ নয়, গত লোকসভার নির্বাচনে রাজ্যে ভাল ফল করার পর থেকে বিধানসভার নির্বাচনের আগে পর্যন্ত বিজেপিতে যোগ সেলিব্রিটি জগতের তারকাদের সাথেও দূরত্ব বাড়ছে দলের। সম্প্রতি বিজেপি ত্যাগ করেছে টলিউড অভিনেত্রী রূপা ভট্টাচার্য ও অনিন্দ্য পুলক ব্যনার্জি। দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন আরেক টেলি তারকা রিমঝিম মিত্র। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে তৃণমূলের বিধায়ক ও সাবেক মন্ত্রী মদন মিত্রের সাথে দেখা গিয়েছিল রিমঝিম মিত্রকে, আর সেই থেকেই তার তৃণমূলে যোগদানের জল্পনা ছড়িয়েছে।
তবে কেবল বিজেপিতেই নয়, ভোট পরবর্তী বাংলায় কংগ্রেস শিবিরেও ভাঙন অব্যাহত। জুলাই মাসে কংগ্রেসের সংস্পর্শ ত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দেন ভারতের সাবেক কংগ্রেস সাংসদ, বিধায়ক ও দেশটির সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত প্রণব মুখার্জির পুত্র অভিজিৎ মুখার্জি। সকলকে চমকে দিয়ে গত আগষ্টের মাঝামাঝি তৃণমূলে যোগ দেন সাবেক কংগ্রেস সাংসদ ও সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি সুস্মিতা দেব। গত সপ্তাতেই তৃণমূলে ফিরেছেন দলের সাবেক বিধায়ক ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি প্রয়াত সোমেন মিত্রের স্ত্রী শিখা মিত্র।
সবমিলিয়ে বাংলার রাজনীতিতে এখন ছন্নছাড়া অবস্থা বিজেপির। অন্যদিকে শতাব্দী প্রাচীন দল কংগ্রেসও ধীরে ধীরে আরও অস্বিত্বহীন হয়ে পড়ছে।
তবে গত দুই দিনে দুই জন বিজেপি বিধায়কদের তৃণমূলে যোগদানের প্রসঙ্গে মুখ খুলেছেন দলের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। বুধবার তিনি বলেছেন ‘এরা বিজেপি নেতা ছিলেন না। দলের টিকিট পেয়ে জিতেছিলেন। এদের বিরুদ্ধে দলবিরোধী আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারাই এমন করবেন তদের বিরুদ্ধেই এবার পদক্ষেপ নেওয়া হবে, প্রয়োজনে দল আদালতের দ্বারস্থ হবে।’ তার অভিমত ‘এক দলের টিকিটে জিতে অন্য দলে যোগ দেওয়া কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটা অন্যায়।’