মনে আছে কালো দিন! জেনে নিন জরুরি অবস্থার সেই ইতিহাস

 

খবর এইসময়, নিউজ ডেস্কঃ  আজ ২৫ শে জুন।আজকের এই দিনটি ভারতীয় রাজনীতিবিদদের কাছে কালাদিন।ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশবাসীর সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার কেড়ে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন, আচমকা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷ বিরোধীরা চরম সমালোচনা করে বলেছিল, বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ৷ ইন্দিরার বিনাশ যে দ্রুত ঘনিয়ে আসছে, সম্ভবত এই দেওয়াল লিখন পড়ে ফেলেছিলেন বিরোধীরা৷ ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে গোহারা হারতে হয়েছিল আয়রন লেডিকে৷ জরুরি অবস্থার মূল্য চোকাতে হয়েছিল তাঁকে৷ পরে অনেক সংগ্রাম করে হারানো জমি এবং মানুষের ভালোবাসা তিনি ফিরে পেয়েছিলেন৷ মানুষ আবার তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসায়৷ কিন্তু জরুরি অবস্থার কলঙ্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি৷ এমনকী মৃত্যুর পরেও তাঁর বংশধরদের আজও জরুরি অবস্থার জন্য বিদ্ধ করে থাকে বিরোধীরা৷

জরুরি অবস্থার কথা অনেকেই জানেন৷ এর নেপথ্য কাহিনিও তাদের জানা৷ তবুও আজকের দিনে জরুরি অবস্থার নানা ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা হবেই হবে৷ জরুরি অবস্থার ঘটনা দেশের রাজনীতিকদের কাছে একটা শিক্ষা৷ ক্ষমতার লোভ মাথায় চেপে বসলে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হতে পারে সেটাই বর্ণিত আছে জরুরি অবস্থার ইতিহাসে৷

১৯৭১ সালে লোকসভা ভোটে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় ফেরেন ইন্দিরা গান্ধী৷ ৫১৮টি লোকসভা আসনের মধ্যে কংগ্রেস একাই পায় ৩৫২টি আসন৷ হিসেব মতো পরবর্তী লোকসভা ভোট হওয়ার কথা ছিল ১৯৭৬ সালে৷ কিন্তু তার আগেই জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে দেন ইন্দিরা গান্ধী৷ মূলত ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশবাসীর সংবিধানপ্রদত্ত মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি৷

জরুরি অবস্থা ঘোষণার কিছুদিন আগে ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরিয়েছিল৷ রাজনারায়ণের আনা মামলায় ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন৷ ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রার্থী রাজনারায়ণের অভিযোগ ছিল রায়বেরিলিতে ভোটারদের মদের বোতল দিয়ে প্রভাবিত করেছিলেন৷ নির্বাচনী প্রচারে বায়ুসেনা বিমানের অপব্যবহার করেছিলেন৷ আদালতে ইন্দিরা গান্ধী দোষী সাব্যস্ত হলেন৷ তাঁর সাংসদ পদ ৬ বছরের জন্য খারিজ করে দেওয়া হল৷ এমনকী এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগনমোহনলাল সিং রায়বেরিলি লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার খারিজ করে দিয়েছিলেন৷

এরপর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে জরুরি বৈঠকের ডাক পড়ল৷ দলের নেতাদের কাছে উপদেশ চাইলেন ইন্দিরা৷ ছেলে সঞ্জয়ের পরামর্শ মেনে ইন্দিরা গান্দী সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করলেন৷ সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের রায় পুরোপুরি খারিজ করল না৷ ইন্দিরা গান্ধীকে প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার অনুমতি দিল, কিন্তু চূড়ান্ত রায় না বেরনো পর্যন্ত তিনি সাংসদ হিসেবে কোনও ভোট দিতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেয় শীর্ষ আদালত৷

দেশজুড়ে তৈরি হল অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি৷ ২৫ জুন রাতে রাষ্ট্রপতি ফাকরুদ্দিন আলি আহমেদকে দিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার কাগজে সই করিয়ে নেন ইন্দিরা৷ কারণ বলা হয়েছিল, অভ্যন্তরীণ অশান্তি নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি অবস্থা ডাকা হয়েছে৷ জাতীয় স্বার্থে এই সিদ্ধান্ত৷ পরের দিন অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা ছিল, সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে৷ তাই জরুরি অবস্থা ডাকা হল৷ আতঙ্ক হবেন না৷

প্রধানমন্ত্রীর অভয় সত্ত্বেও জনমানসে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল৷ সাধারণ মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়৷ জরুরি অবস্থার সময় ১১ লক্ষ মানুষকে জেলে যেতে হয়েছিল৷শিল্প-সংস্কৃতির কন্ঠরোধ করা হয়। শিল্পীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুলিশ খানাতল্লাশি করে৷ তাদের নানাভাবে হেনস্থা করা শুরু হয়৷ গান, কবিতা, উপন্যাস সবকিছুর উপর চাপানো হয়েছিল সেন্সরশিপ৷ ফলে শিল্প ও সংস্কৃতির উপর আঘাত নেমে আসে৷ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে নেওয়া হয়৷ অনেক প্রবীণ সাংবাদিকদের জেলে পাঠানো হয়৷ জমায়েত, মিটিং-মিছিল নিষিদ্ধ৷ কেড়ে নেওয়া হয় ধর্মঘটের অধিকার৷ অনেক রাজ্যে ছাত্র-ইউনিয়ন ভেঙে ফেলা হয়৷ তাবড় তাবড় বিরোধী নেতাদের জেলে পাঠানো হয়৷ লালকৃষ্ণ আদবানি, অটলবিহারী বাজপেয়ি, মোরারজি দেশাই, জয়প্রকাশ নারায়ণ গ্রেফতার হন৷ ইমার্জেন্সি ডেকে রাতের অন্ধকারে বাবা জহরলালের ইচ্ছে পূরণ করলেন ইন্দিরা।

১৯৭৫ সালের ২৬ শে জুন ভারতের সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনী সই করিয়ে নিলেন রাষ্ট্রপতি কে দিয়ে। বলা হয়, সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর অফিস নয়, দেশ পরিচালনার রিমোর্ট ছিল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তাঁর পুত্রের হাতে৷ ২১ মার্চ ১৯৭৭ সালে তুলে নেওয়া হয় জরুরি অবস্থা৷ বাকিটা ইতিহাস।

 

Google news