মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ভারত-বিরোধী মন্তব্যের জবাবে ভারত একটি দৃঢ় কূটনৈতিক বার্তা দিয়েছে। কৌশলগত অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকার মনোভাবের প্রতি কূটনৈতিক জবাব হিসেবে ভারত রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় (Trilateral Talks) সহযোগিতা আলোচনা (RIC) পুনরায় শুরু করার ইঙ্গিত দিয়েছে। এই পদক্ষেপটি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিবর্তনকে নির্দেশ করে, বিশেষ করে যখন এটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের চীন সফরের পরপরই এসেছে।
ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতার পুনরুজ্জীবন
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানিয়েছেন যে, রাশিয়া, ভারত এবং চীনের (RIC) মধ্যে ত্রিপক্ষীয় আলোচনার (Trilateral Talks) এই উদ্যোগ তিনটি দেশের মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় বৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনার জন্য নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন যে, তিনটি দেশ নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার পরই পরবর্তী বৈঠকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
এই পদক্ষেপটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর সম্প্রতি চীনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। এর কিছুদিন পরেই ভারত এই ত্রিপক্ষীয় আলোচনার পুনরুজ্জীবনের ইঙ্গিত দিল। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও জয়সওয়ালের বক্তব্যের পর জানান যে, তিন দেশের মধ্যে সহযোগিতা কেবল এই তিনটি দেশকেই সাহায্য করবে না বরং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি, সহযোগিতা, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকেও উৎসাহিত করবে। চীন ভারত ও রাশিয়ার সাথে RIC সহযোগিতা নিয়ে কথা বলতে প্রস্তুত।
অতীতের প্রেক্ষাপট ও বর্তমান গুরুত্ব
উল্লেখ্য, কয়েক সপ্তাহ আগেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেছিলেন যে, তার দেশ চীন ও ভারতের সাথে ত্রিপক্ষীয় আলোচনা পুনরায় শুরু করার ব্যাপারে গুরুতর। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর গত শতাব্দীর শেষ দশকে এই তিনটি দেশ পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বকে বহুমেরু করার কথা ভেবেছিল। এই ব্যবস্থার আওতায়, তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের শেষ বৈঠকটি ২০২১ সালে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু চীনের সাথে উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের কারণে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ভারত এটিকে গুরুত্ব দিচ্ছিল না।
বর্তমানে, এই পুনরুজ্জীবনকে ভারতের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এটি এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ন্যাটো প্রধান ভারত এবং অন্যান্য ব্রিকস দেশগুলিকে সতর্ক করে বলেছেন যে, তাদের রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে শান্তি আলোচনার জন্য রাজি করানো উচিত, অন্যথায় দিল্লি, বেইজিং এবং ব্রাজিলকে এর পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। ন্যাটো প্রধানের এই হুমকির একদিন পরই ভারতের পক্ষ থেকে RIC-কে এগিয়ে নেওয়ার নতুন সংকেত এল।
কেন এই পদক্ষেপ?
ভারতের এই পদক্ষেপকে কয়েকটি প্রধান দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে যেমন,
- মার্কিন চাপের পাল্টা জবাব: ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভারতের প্রতি যে ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে, তা ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং পররাষ্ট্রনীতিতে হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দেয়। এর জবাবে ভারত আমেরিকার উপর নির্ভরতা কমাতে এবং নিজের কৌশলগত স্বাধীনতা বজায় রাখতে চাইছে। রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে ভারত বোঝাতে চাইছে যে, তার কাছে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিকল্প অংশীদার রয়েছে।
- বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থার আকাঙ্ক্ষা: ভারত দীর্ঘদিন ধরে একটি বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করে আসছে, যেখানে ক্ষমতার ভারসাম্য কোনো একটি দেশের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকবে না। RIC প্ল্যাটফর্মটি এই বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, যেখানে পশ্চিমা ব্লক ছাড়াও অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলিরও প্রভাব থাকবে।
- আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা: RIC দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। তিনটি দেশই এশিয়া মহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি হলে বিভিন্ন আঞ্চলিক সংঘাত নিরসন এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সুবিধা হবে।
- ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য: ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীন-মার্কিন উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে, ভারত নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ব্লকের সাথে পুরোপুরি সংযুক্ত না রেখে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখতে চাইছে। RIC-এর পুনরুজ্জীবন এই ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
যদিও, ভারতের এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র ট্রাম্প প্রশাসনের স্বেচ্ছাচারিতার একটি জবাব নয়, বরং এটি ভারতের দীর্ঘমেয়াদী পররাষ্ট্রনীতির একটি প্রতিফলন, যেখানে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এবং বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থার ধারণা প্রাধান্য পায়। এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং তার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার দৃঢ় সংকল্পের ইঙ্গিত দেয়।
ভারতের এই পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন? আমাদের জানান কমেন্ট করে।